কাগজের বইয়ের মেলায় কাগজহীন টাকা

বইমেলায় জনপ্রিয় হচ্ছে কাগজহীন টাকার লেনদেন। মডেল: লামিসা, ছবি: খালেদ সরকার
বইমেলায় জনপ্রিয় হচ্ছে কাগজহীন টাকার লেনদেন। মডেল: লামিসা, ছবি: খালেদ সরকার

বাংলাদেশের বইয়ের বাজারের বড় লেনদেনই চলে ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলায়। ‘কাগজশূন্য’ পৃথিবীর আশা আরও একটু পিছিয়ে দিয়ে প্রতিবছরই বাড়ছে বইয়ের বিক্রি। তবে একদিক দিয়ে বইমেলা যে কাগজকে সাফল্যের সঙ্গে হটিয়ে দিচ্ছে, সে কাগজ হচ্ছে কাগুজে টাকা। ২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় জয়জয়কার ইলেকট্রনিকস টাকার ও প্লাস্টিক কার্ডের।

বইমেলার বড় প্যাভেলিয়নগুলো তো বটেই। ছোট স্টলগুলোতেও নিয়মিত বিরতিতে বেজে উঠছে ‘বিপ’ শব্দটি। বিপ বাজলেই, অবধারিতভাবে পরের শ্রুত শব্দ, টাকা গেছে ভাই? জবাব আসছে টাকা আসছে। এভাবে মুহূর্তেই ইলেকট্রনিকস লেনদেনে বই কেনা হয়ে যাচ্ছে।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৮ লাখ বর্গফুট নিয়ে বসেছে ২০২০ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাংলা একাডেমিতে ১২৬ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৩৪টি প্রতিষ্ঠানের ৮৭৩টি স্টল ও ৩৮টি প্যাভেলিয়ন নিয়ে কলেবরে বড় হয়েছে বইমেলা। সেই সঙ্গে বেড়েছে ডিজিটাল অর্থ লেনদেনের পরিমাণ।

মোহাম্মদপুর থেকে ঢাকা উদয়ন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র নাইমুর রহমান প্রথমার স্টল থেকে বই কেনেন বিকাশে। বলেন, কত টাকার বই কিনব, এই বিষয়টি আগে থেকে নিশ্চিত করে নির্দিষ্ট পরিমাণ নগদ টাকা নিয়ে বইমেলায় আসা যায় না। বই পছন্দ হলে যেকোনো পরিমাণ বই পাওয়া যাচ্ছে, এটা একটা স্বাধীনতা। একই প্রতিষ্ঠান থেকে কার্ডে বই কেনেন মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম। যেকোনো পরিমাণ বই কিনতে পারার স্বাধীনতায় তিনিও মুগ্ধ। বলেন, প্লাস্টিকের এই টাকা কেনাকাটাকে অনেক নিরাপদ করেছে।

২০১৪ সাল থেকে বিকাশ প্রথমবারের মতো বইমেলায় নগদ টাকার বদলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বই কেনার সুবিধা দেয়। সে বছর মাত্র ৭৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে বিকাশের মাধ্যমে বই কেনা যেত। এই বছর বইমেলার ৯০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বিকাশের সেবার আওতায় রয়েছে। বিকাশের পাশাপাশি এ বছর বইমেলায় এগিয়ে এসেছে ব্যাংকগুলোও। আগে বই কিনতে হলে ধারেকাছের বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করা লাগত। সীমিতসংখ্যক বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকত, পস বা পয়েন্ট অব সেল মেশিন। এ বছর সিটি ব্যাংক ১৫০টি প্রতিষ্ঠানে পস মেশিন দিয়েছে, যা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যেই বই কিনছেন গ্রাহকেরা।

শুধু ইলেকট্রনিক টাকা নয়, অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান আইপিডিসি এবার বইমেলায় দিয়েছে বই কেনার ঋণও। ‘সুবোধ’ নামে অভিনব এই ঋণব্যবস্থা কাজ করে বিকাশের মাধ্যমে। তিন মাসে পরিশোধযোগ্য সর্বোচ্চ তিন হাজার টাকার এই ঋণকে রাখা হয়েছে সুদমুক্ত।

‘সুবোধ’ থেকে সুবিধা নিয়ে বই কেনেন সংবাদমাধ্যমকর্মী মুনির মমতাজ। তিনি বলেন, ঋণব্যবস্থার শর্ত, তিনটির বেশি প্রতিষ্ঠান থেকে বই কেনা যাবে না, এটি একটি সমস্যা। এ ছাড়া ঋণ পরিশোধের সময় বিকাশে ফেরত দিতে গেলে বিকাশের ফি পরিশোধ করতে হবে কি না, এ বিষয়েও দ্বিধা থাকছে। তারপরও বইকেনার মূল বাজেটের সঙ্গে ঋণ যোগ করলে টাকার পরিমাণ মন্দ হচ্ছে না।

আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সুবোধ প্রথমবারের মতো বইমেলায় এই সুবিধা নিয়ে এসেছে। এটা আমাদের জন্য যেমন নতুন, পাঠকের জন্যও নতুন। তারপরও শনিবার পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক  মানুষ এখান থেকে ঋণ নিয়েছে।

মমিনুল ইসলাম আরও জানান, আইপিডিসি তরুণদের এই ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে আইপিডিসির পরিচয় বাড়াতে চায়, যেন ভবিষ্যতে আর্থিক লেনদেন করার সময় তাঁরা আইপিডিসিকে বিবেচনায় রাখেন। আর এখন পর্যন্ত যাঁরা ঋণ নিয়েছেন তাঁদের ৬০ শতাংশই শিক্ষার্থী।

ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন অফারও দিচ্ছে। বিকাশ থেকে বই কেনা হলে তাৎক্ষণিক ১০ শতাংশ ক্যাশ ব্যাকের সুযোগ রয়েছে। আর সিটি ব্যাংকে আমেরিকান এক্সপ্রেস কার্ড দিচ্ছে ২৫ শতাংশ ক্যাশব্যাক। এর ফলে ডিজিটাল লেনদেনে ক্রেতাদের আগ্রহও বাড়ছে। এতে খুশি প্রকাশকেরাও। চারুলিপি প্রকাশনের প্রকাশক হুমায়ূন কবির বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যখন বিকাশের সম্পর্ক হয়, তখন খুব কম ক্রেতা এভাবে লেনদেন করতেন। এখন বিকাশ ও কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটা অনেক বেড়েছে।’ খুব নির্দিষ্টভাবে ক্রেতার সংখ্যাটা না বলা গেলেও টাকার অঙ্কে সেটা নেহাতই কম নয় বলেই জানান এই প্রকাশক।

বইমেলার ডিজিটাল লেনদেন নিয়ে বিকাশের চিফ মার্কেটিং অফিসার মীর নওবত আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের বইমেলায় ৫০ হাজার মানুষ বিকাশের মাধ্যমে বই কিনেছে। এই বছর আমাদের লক্ষ্য ১ লাখ মানুষকে বিকাশ লেনদেনের আওতায় আনা।’

বইমেলায় কেনাকাটায় পস মেশিনকে জনপ্রিয় করতে চায় সিটি ব্যাংকও। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘বইমেলায় কার্ড ব্যবহারে ছাড় দেওয়া ব্যাংকের কোনো সামাজিক দায়মূলক কাজ নয়। আমরা এই অর্থ লগ্নি করছি মানুষকে কার্ড ব্যবহারে অভ্যস্ত করানোর জন্য। এভাবে কার্ডের ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, কমবে নগদ অর্থের ব্যবহার।’