সঞ্চয়ের ওপর এবারই সবচেয়ে কম সুদ

আলোচনায় এখন ডাকঘরের নানা সঞ্চয় কর্মসূচি। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
আলোচনায় এখন ডাকঘরের নানা সঞ্চয় কর্মসূচি। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

কোনো সঞ্চয়ের ওপর এত কম সুদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই নেওয়া হয়নি, সরকার যা নিল ১৩ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার। ওই দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ যখন ডাকঘর সঞ্চয় কর্মসূচির (স্কিম) সুদের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রজ্ঞাপন জারি হলো, মাথার ওপর যেন বাজ পড়ল আমানতকারীদের। মধ্যবিত্ত, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী ও নারীরাই সাধারণত এ কর্মসূচিতে আমানত রাখেন।

তবে কিছুটা কষ্ট লাঘবের অপেক্ষায় থাকতেই পারেন তাঁরা, যদি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কথার প্রতি আস্থা রাখতে চান। সচিবালয়ে গত বুধবার অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে ইঙ্গিত দিয়েছেন, যেহেতু আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তাই এই হার পুনর্বিবেচনা করা হবে। অর্থাৎ কমিয়ে দেওয়া সুদের হার কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করবেন তিনি। যদিও তা কবে করা হবে, সেই দিনক্ষণ আর বলেননি অর্থমন্ত্রী।

সুদের হার কমানোর পর বিভ্রান্তি তৈরি হয় যে পুরো সঞ্চয়পত্রের সুদের হারই কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি না। অর্থ মন্ত্রণালয় ১৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, সঞ্চয়পত্রের ওপর নয়, নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শুধু ডাকঘর সঞ্চয় কর্মসূচির ওপর। কর্মসূচির আওতায় ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক (সাধারণ হিসাব), ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক (মেয়াদি হিসাব) এবং ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক (বোনাস হিসাব)—এ তিন ধরনের হিসাব ছিল। ১৯৯২ সাল থেকে বোনাস হিসাবটি বন্ধ রয়েছে। বাকি দুটি চালু। 

ডাক অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো কর্মসূচি এটি। চালু হয় ব্রিটিশ সরকারের আমলে ১৮৭২ সালে। ডাক-হরকরাদের কিছুটা সুবিধা দিতে এই কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। বাংলাদেশে এ কর্মসূচি চালু হয় ১৯৭৪ সালে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা বৃদ্ধির স্বার্থে। কর্মসূচি পরিচালিত করতে ১৯৮১ সালে করা হয় ‘ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক বিধি’। সেই থেকে ওই বিধির আওতায় তা পরিচালিত হয়ে আসছে। তবে নাম ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক বিধি হলেও বাস্তবে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক বলতে কোনো ব্যাংক নেই দেশে। আবার পুরো বিষয়টি দেখভালও করে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, ডাক অধিদপ্তর নয়।

যে কর্মসূচির সুদের হার অর্ধেকে নামিয়ে আনা হয়েছে, তার আকার কত? সঞ্চয় অধিদপ্তরের ২০১৯ সালের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সাধারণ হিসাব ও মেয়াদি হিসাব মিলিয়ে পুঞ্জীভূত দায় ৩৯ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে মেয়াদি হিসাবেই বেশি অর্থাৎ ৩৬ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। আর সাধারণ হিসাবে ২ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। অধিদপ্তরের হিসাবই বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দুটি হিসাব মিলিয়ে আমানত হয়েছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সাত মাস পেরিয়ে আট মাস চলছে। এর মধ্যে দুই হিসাবে আমানত পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা গেছে।

সুদের হারের ইতিহাস

ডাকঘর সঞ্চয় কর্মসূচির সাধারণ হিসাবের ক্ষেত্রে সুদের হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। আর মেয়াদির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ৩ বছর মেয়াদি হিসাবের সুদের হার হবে ৬ শতাংশ, যা এত দিন ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ ছিল।

মেয়াদপূর্তির আগে ভাঙানোর ক্ষেত্রে এক বছরের জন্য সুদ পাওয়া যাবে ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া ২ বছরের ক্ষেত্রে সুদ হবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ, আগে যা ছিল ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। ১৩ ফেব্রুয়ারি নতুন হার নির্ধারণ করার আগে শেষবার পরিবর্তন করা হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৩ মে, যা ৫ বছর ধরে চলে আসছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৪ সালে চালুর পর থেকে এই কর্মসূচির আওতায় মেয়াদি আমানতের সুদ ১৬ বার পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালে শুরুর বছর এ আমানতে সুদ ছিল ১০ শতাংশ। মাঝখানে এই আমানতের বিপরীতে ১৯৮৮-১৯৯২ সময়ে সুদ ছিল ১৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ। তবে এবারের মতো এত কম হার দেশের ইতিহাসে কখনোই করা হয়নি।

আর সাধারণ হিসাবের সুদের হার শুরুর বছর ১৯৭৪ সালে ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। মাঝখানে ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত এ আমানতে সুদের হার ছিল ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে ২০০৪ সাল থেকে আবার এই হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করে এত বছর চালু রাখা হয়েছিল। নতুন হার করা ৫ শতাংশ এ যাবৎকালের সর্বনিম্ন। ব্যাংক খাতের কোনো আমানত কর্মসূচিতে এত কম সুদ নেই বলে জানা গেছে।

কারা কত টাকা রাখতে পারেন

সাধারণ ও মেয়াদি উভয় হিসাবেই টাকা রাখা যায় একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ ও যুগ্ম নামে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা। হিসাব দুটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি নাগরিকই এতে টাকা রাখতে পারেন। আবার নাবালকের পক্ষেও টাকা রাখার সুযোগ রয়েছে। উভয় হিসাবেই নমিনি নিয়োগ যেমন করা যায়, তেমনি তা পরিবর্তন করা যায় এবং বাতিলও করা যায়। অন্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে, সাধারণ হিসাবে এক মাসেও সুদ তোলা যায়। আর মেয়াদি হিসাবে ছয় মাস পরপর সুদ তোলা যায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগ করার সুবিধাও রয়েছে এতে। 

ডাক অধিদপ্তর ও সঞ্চয় অধিদপ্তর সুদের হার কমানোর বিষয়ে পুরোপুরিই অন্ধকারে ছিল বলে জানা গেছে। যোগাযোগ করলেও দুই অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। সংস্থা দুটির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান,                                  ব্যাংকে আমানতের সুদ কমানোর যে সিদ্ধান্ত সরকার কার্যকর করতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে মিল রেখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু সরকারের বিবেচনায় এ–ও থাকা উচিত যে কিছু মানুষকে তো সুরক্ষাও দিতে হবে, যাদের বিনিয়োগের কোনো জায়গা নেই।