চট্টগ্রাম: কত দূরে বাণিজ্যিক রাজধানী

চট্টগ্রাম বন্দর, বাণিজ্যিক রাজধানীর প্রাণ। ছবি: সৌরভ দাশ
চট্টগ্রাম বন্দর, বাণিজ্যিক রাজধানীর প্রাণ। ছবি: সৌরভ দাশ
>বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। ঘোষণা অনেক আগের। অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল, তবে বাস্তবায়ন সামান্যই। অনেক কিছুই এখন কাগজে-কলমে। তাহলে কী করতে হবে। এবারের আয়োজন বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে নিয়েই।

কী ছিল না চট্টগ্রামে? বন্দর ঘিরে প্রাচীনকালে এখানে নোঙর করেছিল একের পর এক বিদেশি শক্তি। ব্যবসা–বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল এ নগর। তারও পরে ষাট থেকে সত্তর বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল বহু হালকা, মাঝারি ও ভারী শিল্প খাতেরও। বাণিজ্যের প্রয়োজনে ছুটে এসেছিল বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও। 

তবে ব্যবসা–বাণিজ্যের জন্য সহায়ক অবকাঠামো ও নীতিগত অনুমোদনের সুবিধা ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এই স্রোতে ভাটা পড়তে থাকে। কয়েক দশক ধরে চট্টগ্রাম ছেড়ে যেতে থাকে উদ্যোক্তারা। বড় দুই দল নানা সময়ে চট্টগ্রামকে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ করার ঘোষণা দিয়েও ফেরাতে পারেনি উদ্যোক্তাদের। ঢাকা যখন আর চাপ নিতে পারছে না, তখনই চট্টগ্রাম ঘিরে অবকাঠামো নির্মাণের নানা উদ্যোগ ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’র আলোচনা আবার ফিরিয়ে আনছে। 

ব্যবসায়ীরা জানান, বাণিজ্যিক রাজধানী হলে বাণিজ্য-সংক্রান্ত সব ধরনের সেবা চট্টগ্রামেই পাওয়া যাবে। ব্যবসায়ীদের ঢাকায় দৌড়াতে হবে না। আবার ব্যবসা–বাণিজ্যের জন্য সহায়ক অবকাঠামোও থাকবে চট্টগ্রামে। দীর্ঘদিন ধরে শিল্পকারখানা স্থাপন ও আমদানি–রপ্তানির অনেক সেবার অনুমোদন ঢাকা থেকে নিতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। চট্টগ্রামে কয়েকটি কার্যালয় শক্তিশালী করলেও বা অনলাইনে সেবা চালু হলেও এখনো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঢাকার ওপর নির্ভরতা বেশি।

এমন নির্ভরতার সময় মিরসরাই থেকে শুরু করে টেকনাফ পর্যন্ত সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল, সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, টানেল ও যোগাযোগব্যবস্থাসহ বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে শিল্প–বাণিজ্যবিষয়ক অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই চট্টগ্রামের সরকারি সংস্থাগুলোর। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর অবকাঠামো নির্মাণ হলেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঢাকা থেকে। 

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চীনের সাংহাই, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক কিংবা ভারতের মুম্বাই গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক নগর হয়েছে ব্যবসা–বাণিজ্যের সহায়ক সব সুবিধা থাকার কারণে। ঘোষণা দিয়ে নয়, চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার জন্য অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে ঢাকার বাইরে অনেক সংস্থার প্রধান কার্যালয় নেওয়া হলেও পরে তা ফিরিয়ে নেওয়া হয়। চট্টগ্রামের যে কয়টি আছে, তা–ও ঢাকার মুখাপেক্ষী। তিনি বলেন, মিরসরাই থেকে টেকনাফ পর্যন্ত যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, তার গতি ত্বরান্বিত করতে হলে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। সেটা হলে সুফল পাবে পুরো বাংলাদেশ।

স্থানীয় লোকজনের দাবির পর চট্টগ্রামকে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ হিসেবে বাস্তবায়নের জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তা যাচাই করতে গত বছর একটি কমিটি গঠন করে সরকার। চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনারকে আহ্বায়ক এবং জেলা প্রশাসককে সদস্যসচিব করে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এখন পর্যন্ত একটি সভা করেছে।

জানতে চাইলে কমিটির সদস্যসচিব চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক, শুধু একটি সভা হয়েছে। তবে বর্তমান সরকার ব্যবসাবান্ধব সরকার। চট্টগ্রামকেও সরকার গুরুত্ব দিয়ে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। মূল বিষয় হচ্ছে, ব্যবসা–বাণিজ্যসংক্রান্ত অনুমোদন যাতে চট্টগ্রাম থেকেই নেওয়া যায়, সেটি নিয়ে কাজ করা। এ জন্য শুধু কমিটিই নয়, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী নেতাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

শুরুতেই হোঁচট

বাণিজ্যের প্রয়োজনে বিদেশি ক্রেতা–বিনিয়োগকারীদের সরাসরি চট্টগ্রামে আসার জন্য দরকার আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর। চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থাকলেও মাত্র নয়টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ফ্লাইট চলাচল করছে। কলকাতা ছাড়া বাকি সব গন্তব্যই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। এক যুগে বন্ধ হয়েছে সিঙ্গাপুর, কুয়েত, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া রুট। চট্টগ্রাম ছেড়েছে সাতটি বিদেশি এয়ারলাইনসও। অর্থাৎ ঢাকা হয়েই চট্টগ্রামে আসতে হবে বিদেশি ক্রেতা–বিনিয়োগকারীদের। শুধু বিদেশি কেন, চট্টগ্রামের যেসব উদ্যোক্তা নিয়মিত বিদেশে যেতে হয়, তাদেরও প্রথমে ঢাকার পথ ধরতে হয়। আবার এখান থেকে ফেরার সময়ও। 

আন্তর্জাতিক ছাড়াও আকাশপথে দেশীয় রুট বলতে আছে চট্টগ্রাম–ঢাকা। এমনকি সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও আসা যায় না চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারেও নেই। চট্টগ্রামের আকাশপথও সীমিত। এমন ঝক্কি নিয়ে বিদেশি ক্রেতা বা বিনিয়োগকারীরা চট্টগ্রামে যদি আসেন, তাহলে থাকার মতো পাঁচ তারকা হোটেল একটিই। তা–ও বছর পাঁচেক আগেও চালু হয়। র্যাডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউ হোটেল চালু হলেও এটিই এখন পর্যন্ত একমাত্র তারকা হোটেল। ফলে হোটেল বাছাই করার কোনো সুযোগ নেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের। যানজট হলে বিমানবন্দর থেকে এই হোটেলে আসা–যাওয়ার জন্য ঘণ্টা চারেক সময় হাতে রাখতে হয়। 

আকাশপথ ছাড়াও সড়কপথে সারা দেশের সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা খুব বেশি প্রসার হয়নি। ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের চার লেনই একমাত্র ভরসা। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে এখান থেকে সারা দেশে হাইওয়ে থাকার প্রয়োজন থাকলেও তা হয়নি। রেলপথেও পণ্য বা কনটেইনার পরিবহনে গতি আসেনি। নৌপথে অবশ্য দেশের নানা অঞ্চলে পণ্য পরিবহন হচ্ছে। 

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, জোর করে কোথাও উদ্যোক্তাদের নেওয়া যাবে না। যেদিকে ব্যবসা–বাণিজ্যের সুবিধা থাকবে, সেদিকেই উদ্যোক্তারা যাবেন। চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে যেটি হয়েছে, ঢাকার মতো এখানে অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। পাঁচ তারকা হোটেল ছিল না দীর্ঘদিন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগব্যবস্থাও সেভাবে নেই, চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশে যোগাযোগকাঠামোও অত্যাধুনিক নয়। তাতে ঢাকামুখী হয়েছে সবাই।

চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষমাণ কনটেইনার। ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষমাণ কনটেইনার। ছবি: প্রথম আলো

সিংহভাগ অনুমোদন ঢাকায়

চট্টগ্রামে কোনো উদ্যোক্তা ব্যবসা–বাণিজ্য বা শিল্পকারখানা স্থাপন করতে চাইলে তাঁকে বারবার ঢাকায় ছুটে যেতে হবে। ব্যাংকঋণ থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে অনুমোদনের জন্য ব্যবসায়ীদের এই দৌড় এখনো থামেনি। দেশে ৫৯টি ব্যাংকের কার্যক্রম থাকলেও একটিরও প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে নেই।

খাদ্যশস্যসহ উদ্ভিজ্জাত পণ্য আমদানি করতে হলে ব্যাংকে ঋণপত্র খোলার আগে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের আমদানি ছাড়পত্র (আইপি) নিতে হয়। এটি একবার চট্টগ্রামে, আবার ঢাকায়—এভাবেই চলছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কার্যালয়ে এই ক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে ব্যবসায়ীদের এক বছর লড়াই করতে হয়েছে।

শিল্পকারখানার উৎপাদিত পণ্য বা আমদানি পণ্যের মান পরীক্ষা ও তদারকির জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) চট্টগ্রামে একটি কার্যালয় আছে। তবে সংস্থার তালিকাভুক্ত ১৮১টি পণ্যের মধ্যে ৭৬টি পণ্যের মান পরীক্ষা ও লাইসেন্সের                    ক্ষমতা নেই এই কার্যালয়ের। আবার বন্দরে পণ্য পড়ে থাকলেও ঢাকা থেকে পরীক্ষার প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত ১৩টি পণ্য ছাড় করা যায় না। এ জন্য জরিমানা দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। 

আমদানি-রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে ৫৫টি সেবা দেওয়া হয়। এসব সেবার মধ্যে ২৮টিই ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে নিতে হয়। মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ ২৮ ধরনের পণ্যের আমদানি ও রপ্তানির অনুমতির জন্য ঢাকায় দৌড়াতে হয় ব্যবসায়ীদের। শিল্পকারখানায় বয়লার বসানোর আগে আমদানির ছাড়পত্র কিংবা বয়লারের নিবন্ধন পেতে হলেও ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। চট্টগ্রামে কার্যালয় থাকলেও চূড়ান্ত অনুমোদন হয় ঢাকার প্রধান কার্যালয় থেকে। পণ্য রপ্তানির আগে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হিসেবে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে নিবন্ধন নিতে হয়। চট্টগ্রামে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর কার্যালয় এ–সংক্রান্ত যাচাই–বাছাই কাজ করলেও নতুন নিবন্ধনের অনুমোদন দেওয়া হয় ঢাকা থেকে। 

দেশের একমাত্র পুরোনো জাহাজভাঙা কারখানার অবস্থান চট্টগ্রামে। তবে পুরোনো জাহাজ আমদানি থেকে কাটা পর্যন্ত চারবার ব্যবসায়ীদের ঢাকায় যেতে হবে। ঋণপত্র খোলা থেকে শুরু করে ভাঙা পর্যন্ত ধাপে ধাপে চারটি অনুমোদন নিতে হয় মন্ত্রণালয় ও সংস্থার। 

আবার কোম্পানি গঠন করতে হলে নিবন্ধন নিতে হয় যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় থেকে। চট্টগ্রামে এই কার্যালয়ের প্রধান কর্মকর্তা বা উপনিবন্ধক ঢাকা থেকে এসে সপ্তাহে এক-দুই দিন বসেন। ফলে উদ্যোক্তাদের অপেক্ষা করতে হয়। অথচ দেশভাগের পর প্রথম এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় ছিল চট্টগ্রামেই। ১৯৬২ সালে ঢাকায় স্থানান্তর হয়। 

পোশাক কারখানার যন্ত্রপাতি আমদানির জন্যও প্রত্যয়নপত্র নিতে হয় বিজিএমইএ থেকে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, প্রত্যয়নপত্রে সই লাগবে সংগঠনের সভাপতির। চট্টগ্রামে সংগঠনটির প্রথম সহসভাপতি থাকলেও তাঁর ক্ষমতা নেই। 

এত বোঝা মাথায় নিয়ে কারখানা করলেন কোনো উদ্যোক্তা। উৎপাদনও শুরু হলো। কিন্তু উৎপাদিত পণ্য যদি হয় রড, ভোজ্যতেল বা সিমেন্ট, তাহলে আরও একবার ভোগান্তি কাঁধে নিতে হবে চট্টগ্রামের উদ্যোক্তাকে। কারণ, চট্টগ্রামের বিএসটিআই কার্যালয়ের এসব পণ্যের মান পরীক্ষার ক্ষমতা নেই।

প্রথম উদ্যোগ চট্টগ্রামে

অথচ দেশের প্রথম অনেক উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের নাম। রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে যে খাত থেকে, সেই পোশাক খাতের যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে। দেশ গার্মেন্টস থেকে এ যাত্রা শুরু হলেও গ্যাস–বিদ্যুৎসহ নানা সেবার সুবিধার কারণে উদ্যোক্তারা ঢাকায় কারখানা করতে বাধ্য হয়েছেন। ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলোও ঢাকাকেন্দ্রিক। তাতে কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে তাদের এখনো সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। 

পোশাক কারখানার চালুর বহু বছর আগে ১৯৫২ সালে চট্টগ্রাম থেকে রড তৈরির কারখানার যাত্রা শুরু হয়। ঢেউটিন তৈরির কারখানা কোল্ড রোল মিলস, বিলেটসহ ইস্পাত কারখানা চিটাগাং স্টিল মিলস, জাহাজভাঙা ও নির্মাণ কারখানার গোড়াপত্তন হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। মোটরগাড়ি, ফ্রিজ, পেপার মিল, রঙের কারখানাসহ বহু নতুন উদ্যোগের যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। চা–বাগানের সিংহভাগ সিলেটে হলেও বাণিজ্যনগর হিসেবে নিলাম কেন্দ্র চালু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে।

চল্লিশের দশকে ভারত উপমহাদেশে প্রথম মুসলিম পরিচালিত কমরেড ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয় চট্টগ্রাম থেকে। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৯ সালে বাঙালি পরিচালিত প্রথম ব্যাংক ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের (বর্তমানে পূবালী ব্যাংক) প্রধান কার্যালয় ছিল এখানে।

আজ থেকে ১১৫ বছর আগে ১৯০৫ সালে বিদেশি ব্যাংক এ এন জেড গ্রিন্ডলেজ চট্টগ্রামের সদরঘাটে প্রথম শাখা চালু করেছিল। এই ব্যাংক ২০০০ সালে অধিগ্রহণ করে বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ন্ড চাটার্ড ব্যাংক। তারাও ১৯৪৮ সালে এ অঞ্চলে চট্টগ্রামে শাখা কার্যালয় দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। 

বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও ঢাকার পরিবর্তে চট্টগ্রাম থেকে কারখানা বা ব্যবসা চালু করেছিল। ইস্পাহানি গ্রুপ কলকাতা থেকে এই অঞ্চলে প্রথম চট্টগ্রামেই তাদের ব্যবসা স্থানান্তর করেছিল। এই অঞ্চলে প্রথম চট্টগ্রামে ছুটে এসেছিল বহুজাতিক কোম্পানি ইউনিলিভার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বার্জার, ডানকান ব্রাদার্সসহ অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তারাই এখন প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে ঢাকায় নিয়েছে। 

কনটেইনার ভর্তি জাহাজ। ছবি: সৌরভ দাশ
কনটেইনার ভর্তি জাহাজ। ছবি: সৌরভ দাশ

চট্টগ্রাম বন্দরও অবহেলিত

দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর ঘিরে বাণিজ্য নগরী হিসেবে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম। বন্দরের কারণেই এখানে হালকা, মাঝারি ও ভারী শিল্পের সূচনা হয়। এখনো সমুদ্রপথে সারা দেশে কনটেইনারে আমদানি–রপ্তানির ৯৮ শতাংশই এই বন্দর দিয়ে পরিবহন হয়। পণ্য হিসেবে চট্টগ্রাম দিয়ে পরিবহন হয় ৯৩ শতাংশ। 

দেশের অর্থনীতিতে এমন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পরও গত এক যুগে চট্টগ্রাম বন্দরে নতুন কোনো টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়নি। এ জন্য গত চার বছরের বেশির ভাগ সময় জাহাজজট থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি চট্টগ্রাম। এর খেসারত দিতে হচ্ছে সারা দেশের আমদানি–রপ্তানিকারকদের। বরং এ সময়ে চট্টগ্রামে সম্প্রসারণ না করে পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরকে গভীর সমুদ্রবন্দর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেটির নির্মাণকাজই শুরু করা যায়নি। 

অবশ্য এখন আবার চট্টগ্রাম বিভাগের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে। এক যুগ পর পতেঙ্গায় একটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের মাঝে বে টার্মিনাল নির্মাণ কার্যক্রম গতি হারিয়েছে। 

প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মিরসরাই যে বৃহৎ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে, প্রতিবেশী দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য প্রস্তুতি চলছে, সে জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের সম্প্রসারণের বিকল্প নেই। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দর সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। তার ফল হচ্ছে এখনো জাহাজজট লেগে আছে। প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত দেশ করতে চায়। কিন্তু বন্দরই যদি সম্প্রসারণ না হয়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। এখন কারা এটা চায় না, তা চিহ্নিত করতে হবে।

কখন হবে বাস্তবায়ন

দুই দশক আগে থেকে বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়নের দাবি ওঠে। বিএনপি সরকার ২০০৩ সালের ৬ জানুয়ারি এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করে। তাতে ১৬টি কর্মসূচি ছিল। মন্ত্রিসভার ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, যেকোনো একটি ব্যাংক বা বিমা কোম্পানির সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া শিক্ষা, প্রশাসনিক, যোগাযোগ, পর্যটন, বন্দরসহ যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক দপ্তর চট্টগ্রামে রয়েছে, সেগুলোর ক্ষমতা বাড়ানো হবে। এসব সিদ্ধান্তের কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮, ২০১০ ও ২০১৪ সালে তিনটি জনসভায় চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর উড়ালসড়ক নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ‘আমরা চট্টগ্রামকে প্রকৃত অর্থেই বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করছি।’ 

দাবি ও আশ্বাসের মধ্যে বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বন্ড লাইসেন্স ইস্যু, নবায়ন, কাঁচামাল আমদানির অনুমোদনের জন্য পূর্ণাঙ্গ বন্ড কমিশনারেটের অফিস চালু করা হয়েছে ২০১১ সালে। আগ্রাবাদে চট্টগ্রাম চেম্বারের বাণিজ্য নগরের প্রতীক বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র চালু হয়েছে ২০১৬ সালে। তবে পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। হোটেল, ক্লাবসহ অনেক কিছু হয়নি। পাঁচ তারকা মানের একটি হোটেল হয়েছে। আরও দুটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের পথে আছে। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ, রেল যোগাযোগ সুবিধা উন্নীতকরণ, চট্টগ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। 

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, সরকার চট্টগ্রামে অর্থনৈতিক অঞ্চল, টানেল, বিদ্যুৎকেন্দ্র, গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে দুটো বিষয় অগ্রাধিকার দিতে হবে—চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের নৌ, আকাশ, সড়ক ও রেলপথের সংযোগ আরও উন্নত করতে হবে। আর আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। তাহলে বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়নের স্বপ্ন পূরণ হবে।