লবণ নিয়ে হ-য-ব-র-ল

মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে সোডিয়াম সালফেটের বদলে দেদার আমদানি করা হচ্ছে সোডিয়াম ক্লোরাইড বা ভোজ্যলবণ। সেই লবণ সরাসরি প্যাকেটজাত হয়ে বাজারে যাচ্ছে। ফলে দেশে উৎপাদিত অপরিশোধিত লবণের চাহিদা কমে গেছে। সোডিয়াম সালফেটের বদলে আমদানি হওয়া সোডিয়াম ক্লোরাইডের কারণে মিলমালিকদের লবণ বিক্রিতে ধস নেমেছে।

দেশীয় লবণ চাষ ও পরিশোধনকারী শিল্প সংরক্ষণসংক্রান্ত গণশুনানিতে এসব কথা বলেন কয়েকজন লবণচাষি ও মিলমালিক। তাই লবণচাষিরা সব ধরনের লবণের আমদানি শুল্ক বাড়ানোর দাবি করেন। তবে শিল্পোদ্যোক্তারা সেটির বিরোধিতা করে বলেন, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত শিল্প লবণের শুল্ক বাড়ালে শিল্পকারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অন্য দিকে মিলমালিকেরা সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানির অনুমতি চান।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় গতকাল রোববার বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের কার্যালয়ে এই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিশনের চেয়ারম্যান তপন কান্তি ঘোষ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কমিশনের সহকারী প্রধান মো. মাহমুদুল হাসান।

মাহমুদুল হাসান জানান, বিদায়ী অর্থবছরে দেশে ১৮ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে। একই সময়ে সোডিয়াম সালফেট আমদানি হয়েছে ৫ লাখ ৯২ হাজার টন। চলতি অর্থবছর এটি ৭ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ পরিস্থিতিতে অপরিশোধিত সোডিয়াম ক্লোরাইড অনুমোদন দিতে পারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সে ক্ষেত্রে শুল্কহার ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। তার বাইরে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানির সুযোগ নেই। তবে বাণিজ্যিকভাবে সোডিয়াম সালফেট আমদানি করতে পারেন ব্যবসায়ীরা। এ ক্ষেত্রে শুল্কহার ৩১ শতাংশ। তিনি বলেন, অপরিশোধিত লবণ পরিশোধনের সময় মিলভেদে ১৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতি হয়।

>

 ট্যারিফ কমিশনের গণশুনানি। সোডিয়াম সালফেটের বদলে আমদানি হওয়া সোডিয়াম ক্লোরাইডের কারণে লবণচাষি ও মিলমালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে অভিযোগ।

গণশুনানিতে দেশে অপরিশোধিত লবণের চাহিদা ও উৎপাদন, পরিশোধনকালে ক্ষতির হার, অপরিশোধিত লবণ আমদানিতে শুল্ক, সোডিয়াম সালফেটের আমদানি ও শুল্কহার এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও আমদানি করা অপরিশোধিত লবণের তুলনামূলক ব্যয় বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রতিটি বিষয়ে আলোচনায় লবণচাষি, মিলমালিক, শিল্পোদ্যোক্তা, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনসহ (বিসিক) সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা অংশ নেন।

জাতীয় লবণনীতি ২০১৬ অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে দেশে লবণের চাহিদা ১৭ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির সভাপতি নূরুল কবির বলেন, ‘দেশে শিল্প লবণের চাহিদা ১২ লাখ টন। ভোজ্যলবণের চাহিদাও ১২ লাখ টন। আর কস্টিক সোডার চাহিদা রয়েছে সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টন। তবে বিসিক আমাদের কথা মানতে চায় না।’

লবণের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ করা না হলে অনেক সমস্যা সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেন ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান তপন কান্তি ঘোষ। তিনি বলেন, লবণের চাহিদা নিরূপণ করা সমস্যা। আমদানি হলে এক রকম চাহিদা হবে। না হলে চাহিদা হবে ভিন্ন। তবে কেবল দেশীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা নিরূপণ সম্ভব নয়।

লবণ চাষি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি মোস্তফা কামাল চৌধুরী বলেন, ‘গত তিন-চার বছরে লবণচাষি ও মিলমালিকদের অবস্থা খারাপ হয়েছে। একসময় প্রতি কেজি লবণ বিক্রি করে চাষিরা ৮-১০ টাকা পেলেও বর্তমানে পাচ্ছেন ৪-৫ টাকা। তা-ও সময়মতো বিক্রি করতে পারছেন না। চাহিদা যদি বেশি হয়, তাহলে আমাদের লবণ বিক্রি হচ্ছে না কেন?’

কনফিডেন্স সল্টের প্রতিনিধি মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘সোডিয়াম সালফেটের নামে আমদানি হওয়া সোডিয়াম ক্লোরাইড বিভিন্ন কোম্পানি নিজস্ব ব্র্যান্ডের নামে মোড়কজাত করে সরাসরি বাজারে বিক্রি করছে। ফলে আমাদের লবণের বিক্রি কমে গেছে।’ আরেক লবণ ব্যবসায়ী বলেন, ‘সোডিয়াম সালফেটের আড়ালে আমদানি হওয়া সোডিয়াম ক্লোরাইডের কারণে আমাদের লবণের বিক্রি ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।’

সবশেষে ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ‘লবণের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে ফারাক রয়েছে। গণশুনানির মতামত বিচার-বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠাব।’