পেশার নাম 'হাতি খেদা'

মোগল আমল থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ঢাকায় হাতি তাড়ানো  ছিল অন্যতম লাভজনক পেশা
মোগল আমল থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত ঢাকায় হাতি তাড়ানো ছিল অন্যতম লাভজনক পেশা

সিমেন্ট-রড ছাড়া এখন দালানকোঠা নির্মাণ করার কথা চিন্তাও করা যায় না। যখন এ দেশে সিমেন্ট-রড পাওয়া যেত না, তখন কি দালানকোঠা হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। তখন সিমেন্ট-রডের বিকল্প ছিল চুন। চুন ছিল এ দেশের প্রথম খনিজ পণ্য। সিলেটে প্রথম চুনের খনির সন্ধান মেলে। তবে ঢাকা ছিল এই চুন ব্যবসার প্রধান কেন্দ্র। চুনের বেচাকেনা ছিল এ দেশের প্রথম পেশাদারি ব্যবসা। উনিশ শতক পর্যন্ত এই চুন দিয়েই এ দেশে দালানকোঠা নির্মাণ করা হয়েছে।

বস্ত্রের মতো উৎপাদন শিল্পের মন্দাভাব এ দেশের ব্যবসায়ীদের চুন ব্যবসায় বিনিয়োগে উৎসাহিত করে। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে এ দেশে বস্ত্রশিল্পের খারাপ সময় আসতে শুরু করে। বিলাতি বস্ত্রের ভিড়ে ১৮৩০ সালের পরে ঢাকা থেকে প্রধান রপ্তানি পণ্য ঐতিহ্যবাহী মসলিনের পতন শুরু হয়। তবু এ দেশের ব্যবসায়ীরা বসে থাকেননি। বস্ত্রশিল্পের দিন ফুরিয়ে গেলে চুন ব্যবসায় বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। 

ঘরবাড়ি নির্মাণের কাঁচামালের সন্ধান মোগল আমলেই শুরু হয়। সিলেটের তৎকালীন পাহাড়ি পরগনা লাউড়ে প্রথম চুনা খনির সন্ধান মেলে। সিলেট থেকে সারা দেশে চুনের জোগান যেত। সিলেটের খনি থেকে চুন ঢাকায় এনে প্রক্রিয়াজাত করা হতো। ফলে ধীরে ধীরে ঢাকা হয়ে ওঠে চুনের প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র। 

দালানকোঠা নির্মাণ ছাড়াও উৎকৃষ্ট শ্রেণির চুনের গুঁড়া পানের সঙ্গে খাওয়া যেত। সারা বাংলায় পান ছিল তখন সাধারণ মানুষের বিলাসিতার সহজলভ্য ও সুলভ উপাদান। এ ছাড়া আইভরি শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পে তখন চুনের ব্যবহার ছিল। 

আঠারো শতকের শেষের দিকে দুজন গ্রিক ব্যবসায়ী এ দেশে চুনের ব্যবসা শুরু করেন। তাঁরা হলেন এলেক্সি বিচ ও নিকোলাস। ইংরেজ চুন ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন থ্যাকারে। তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী। ইংরেজ ব্যবসায়ী কলিন শেক্‌সপিয়ার এবং রিচার্ডসনও চুনের ব্যবসায় ছিলেন। ওই সময়ে ঢাকায় বসবাসরত অনেক কোম্পানির কর্মচারীরা নামে-বেনামে লবণ ও চুনের ব্যবসা করতেন। ইংরেজ ব্যবসায়ীদের স্থানীয় এজেন্ট ছিলেন রামলোচন সরকার ও গঙ্গারাম ঘোষাল। তাঁরা উভয়েই ঢাকার ব্যবসায়ী ছিলেন। 

বিংশ শতকের শুরুতে চুন ব্যবসায় ভাটা পড়ে। এর পেছনে কারণ ছিল সিমেন্ট ও অন্যান্য নির্মাণশিল্পের কাঁচামালের উৎপাদন শুরু হয়। চুনের জায়গা দখল করে এসব পণ্য। প্রায় এক শতাব্দী পুরো বাংলায় নির্মাণশিল্পের কাঁচামালের জোগান দিত সিলেটের লাউড়ের চুন। 

আঠারো ও উনিশ শতকে আরেকটি পেশাদারি ব্যবসা ছিল ‘হাতি খেদা’। পুরো পূর্ব বাংলাসহ পূর্ব ভারত ছিল হাতি, বাঘ, চিতাবাঘসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। মোগল আমল থেকে পুরো উনিশ শতক পর্যন্ত ‘হাতি খেদা’ ব্যবসার রমরমা অবস্থা ছিল। বনাঞ্চল থেকে কৌশলে হাতি ধরে এনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। প্রশিক্ষিত হাতি বিক্রির জন্য তখন ঢাকায় বাজার ছিল। গড়ে উঠেছিল সরকারি-বেসরকারি খেদা, যেখানে হাতি পোষ মানানোর জন্য রাখা হতো। তখন হাতি ব্যবহৃত হতো মানুষ ও পণ্য পরিবহনের কাজে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই খেদা ব্যবসাকে উৎসাহিত করায় বাংলায় এটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। এই ব্যবসায় নেমে পড়েন কোম্পানির কর্মচারী থেকে শুরু করে অনেক জমিদার। ঢাকার কালেক্টর ডব্লিউ ডগলাস ১৭৯১ সালে একটি সরকারি হাতি খেদার হিসাব দেন। ওই বছর একটি সরকারি হাতি খেদায় খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৪১০ আর্কট রুপি। উনিশ শতকের শেষের দিকে হাতি খেদার ব্যবসায় ভাড়া পড়ে। তখন ইংরেজরা এ দেশের রেল, সড়ক, নৌপথের উন্নয়ন করতে থাকে। হাতির মাধ্যমে মানুষ ও পণ্য পরিবহন কমে যায়। 

সূত্র: ঢাকার বাণিজ্যিক ইতিহাস