মুঠোফোন এখন দেশেই তৈরি হয়

মুঠোফোনের কারখানায় দক্ষতার সঙ্গেই কাজ করছেন দেশি শ্রমিকেরা। গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটনের কারখানায়।
মুঠোফোনের কারখানায় দক্ষতার সঙ্গেই কাজ করছেন দেশি শ্রমিকেরা। গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটনের কারখানায়।
>বাংলাদেশে মুঠোফোন তৈরি সম্ভব, সেটা এখন প্রমাণিত। একটি নয়, দুটি নয়, নয়টি কারখানায় তৈরি ও সংযোজিত হচ্ছে মুঠোফোন। করা হচ্ছে বিপুল বিনিয়োগ। এ নিয়েই এবারের আয়োজন।

যা ছিল স্বপ্ন, তা এখন বাস্তব। মুঠোফোন তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশেই। শুধু কথা বলার জন্য ফিচার ফোন নয়, উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার উপযোগী স্মার্টফোনও তৈরি হচ্ছে এ দেশের কারখানায়। মুঠোফোন কেনার সময় আপনি যদি একটু খেয়াল করে মোড়কটি দেখেন, তাহলে দেখবেন লেখা আছে ‘বাংলাদেশে তৈরি’ অথবা ‘বাংলাদেশে সংযোজিত’। 

এর মানে হলো, কেউ দেশেই মুঠোফোন তৈরি করে। আবার কেউ কেউ তৈরির পথে প্রথম ধাপ, অর্থাৎ সংযোজনে রয়েছে। যেমন দেশি ব্র্যান্ড ওয়ালটনের মুঠোফোন বাংলাদেশে তৈরি হচ্ছে। তেমনি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া স্মার্টফোনের ব্র্যান্ড স্যামসাংয়ের মুঠোফোন বাংলাদেশে সংযোজিত হচ্ছে। আরেক দেশি ব্র্যান্ড সিম্ফনি, দ্রুত অগ্রসরমাণ চীনা ব্র্যান্ড অপো, ভিভো, টেকনো ও ভারতীয় ব্র্যান্ড লাভা বাংলাদেশে কারখানা করেছে। কারখানা রয়েছে ফাইভস্টার ও উইনস্টার নামে দুটি ব্র্যান্ডেরও। সব মিলিয়ে কারখানার সংখ্যা ৯। নতুন করে এসেছে চীনা ব্র্যান্ড রিয়েলমি। তাদের কারখানাও গাজীপুরে।

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, সস্তার স্মার্টফোন সংযোজন বা তৈরি কঠিন কিছু নয়। তাহলে আপনার জানা দরকার, স্যামসাংয়ের নোট ১০ প্লাস এখন বাংলাদেশেই সংযোজিত হয়। দেশে সংযোজন করে ১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার ফোনের দাম ৩০ হাজার টাকা কমিয়েছে স্যামসাং। নতুন আসা এস-২০ সিরিজের ফোনও বাংলাদেশেই সংযোজন করছে স্যামসাং।

আপনি সংযোজনশিল্পকে গুরুত্ব দিতে চান না, তাহলে আপনার আরও কিছুটা জানা দরকার। আগেই বলেছি, ওয়ালটন স্মার্টফোন দেশেই তৈরি হয়। আরেকটি নতুন খবর জানুন, কয়েক মাস পরেই স্যামসাংয়ের মাদারবোর্ড বাংলাদেশে তৈরি শুরু হবে। সিম্ফনি নতুন কারখানা করছে। সেখানে মুঠোফোনের যন্ত্রাংশ, চার্জার ও হেডফোন উৎপাদন করা হবে। টেকনোর কারখানায় মাদারবোর্ড তৈরি হচ্ছে। 

সব মিলিয়ে দেশে মুঠোফোনশিল্পের যাত্রাটি জোরেশোরে শুরু হয়েছে। উদ্যোক্তারা করছেন রপ্তানির চিন্তাও। একটি চালান যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাচ্ছে ওয়ালটন।

জনপ্রিয় হচ্ছে দেশের তৈরি মুঠোফোন। ছবি: সাইফুল ইসলাম
জনপ্রিয় হচ্ছে দেশের তৈরি মুঠোফোন। ছবি: সাইফুল ইসলাম

মুঠোফোন সেবার শুরুর কথা

বাংলাদেশে মুঠোফোন সেবা পরিচালনা বা অপারেটর লাইসেন্স দেওয়া হয় ১৯৮৯ সালে। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮৯ সালে বেতার যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন তিন ধরনের লাইসেন্স দিয়েছিল তখনকার বাংলাদেশ সরকার। সেগুলো হলো পেজার, মুঠোফোন এবং নদী এলাকায় বেতার যোগাযোগব্যবস্থার লাইসেন্স। দেশে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবার যাত্রা শুরু হয় এভাবে। কার্যত দেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর সিটিসেল। 

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ঢাকার কিছু মানুষ হাতে বড় বড় মুঠোফোন নিয়ে ঘুরতেন, যা দেখে অবাক হতেন অন্যরা।

১৯৯৬ সালে সিটিসেলের একক আধিপত্য ভেঙে যায়। সরকার গ্রামীণফোন, একটেল (এখন রবি) এবং সেবা টেলিকমকে (এখন বাংলালিংক) মুঠোফোন সেবা দেওয়ার জন্য লাইসেন্স পায়। এখন দেশের মুঠোফোন সেবার গ্রাহকের সাড়ে ১৬ কোটির বেশি। জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে! মনে রাখতে হবে, একজন মানুষের একাধিক সিম থাকতে পারে। 

শুরুতে নানা ব্র্যান্ডের ফিচার ফোন দেশে আমদানি হয়েছে। যখন মুঠোফোন সাধারণ মানুষের হাতে উঠতে শুরু করে, তখন একক আধিপত্য ছিল নকিয়া ব্র্যান্ডের। প্রথম দেশীয় ব্র্যান্ড সিম্ফনি। ২০০৮ সালে জার্মানির সিমেন্স ব্র্যান্ডের মুঠোফোন ব্যবসা গুটিয়ে যাওয়ার পর সেখানকার কয়েকজন কর্মকর্তা সিম্ফনি ব্র্যান্ডের মুঠোফোন বাজারজাত শুরু করেন। শুরুতে তাঁরা চীন থেকে মুঠোফোন তৈরি করিয়ে আনতেন। ২০১২ সালে দেশে তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা বা থ্রি–জি চালুর পর কম দামের সিম্ফনি ফোন ব্যাপক বাজার পায়।

আমদানি থেকে দেশে মুঠোফোন তৈরির যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে।

 সরকারি নীতি

মুঠোফোনশিল্পের আজকের যাত্রার শুরুটা হয়েছিল সরকারি নীতি দিয়ে। উদ্যোক্তারা জানান, দেশে মুঠোফোন তৈরির কারখানা করতে সরকার উৎসাহ দেওয়া শুরু করে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট থেকে। ওই বাজেটে মুঠোফোনের ৪৪টি যন্ত্রাংশে বড় ধরনের শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়। ৪১টি যন্ত্রাংশে আমদানি শুল্ক করা হয় ১ শতাংশ, যা আগে ৫ থেকে ২৫ শতাংশ ছিল। বিপরীতে তৈরি করা মুঠোফোন আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।

নীতির ফলে একদিকে আমদানি করা মুঠোফোনের খরচ বেড়ে যায়, অন্যদিকে দেশে তৈরি করলে খরচ কমে যায়।

২০১৮ সালের ২৮ জুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেখানে বলা হয়, মুঠোফোন উৎপাদনে কিছু যন্ত্রাংশ উৎপাদন করা এবং ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করার শর্তে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) পুরোপুরি অব্যাহতি দেওয়া হয়। আবার সংযোজনের ক্ষেত্রে ভ্যাট কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে আরও ৪৪টি যন্ত্রাংশের শুল্ক কমানো হয়। বিপরীতে বিদেশি তৈরি মোবাইল আমদানিতে শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়। ফলে এখন আর বিদেশ থেকে আনা মুঠোফোন দিয়ে বাজার ধরা যাচ্ছে না। এ কারণে একের পর ব্র্যান্ড কারখানা করছে। 

৯টি কারখানা

মুঠোফোন সেট তৈরিতে এগিয়ে ওয়ালটন। তারাই প্রথম দেশে কারখানার কাজ শুরু করে। আবার তারাই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে। গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটনের কারখানা উদ্বোধন করা হয় ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। যদিও বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয় ২০১৮ সালের মাঝামাঝি। একই বছরের জুনে স্যামসাং ব্র্যান্ডের মুঠোফোন সংযোজন শুরু করে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস লিমিটেড।

সিম্ফনি ব্র্যান্ডের মুঠোফোন বাজারজাতকারী এডিসন গ্রুপের কারখানাটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে উদ্বোধন করা হয়। তাদের মুঠোফোন বাজারে আসে ডিসেম্বরে। 

এরপর টেকনো ব্র্যান্ডের মুঠোফোন বাজারজাতকারী ট্রানশান, ভিভো, অপো, ফাইভস্টার, উইনস্টার ও লাভা ব্র্যান্ডের ফোনের কারখানা হয়। 

সব মিলিয়ে এখন অন্তত ৯টি কারখানা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বাজার হিস্যাধারীদের মধ্যে কারখানা করার ক্ষেত্রে বাকি রয়েছে মুঠোফোন ব্র্যান্ড হুয়াওয়ে, শাওমি এবং নকিয়া।

৪৩% দেশে

মুঠোফোনের বাজার নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো সমীক্ষা নেই। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হিসাবে, ২০১৯ সালে দেশে ৩ কোটি ২৮ লাখ মুঠোফোন বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে দেশে তৈরি অথবা সংযোজিত প্রায় ১ কোটি ৪২ লাখ ইউনিট। শতকরা হিসাবে যা ৪৩ শতাংশ।

আলোচ্য বছরে দেশে স্মার্টফোন বিক্রি হয়েছে ৭৭ লাখ, যার মধ্যে ৫৪ লাখ দেশে তৈরি অথবা সংযোজিত। বাকিটা বৈধ ও অনানুষ্ঠানিক পথে বাংলাদেশে আসে। অবৈধভাবে আসা মুঠোফোন ঠেকাতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) নিবন্ধন ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। যেটি চালু হলে অবৈধ মুঠোফোন ব্যবহার করা যাবে না। 

দেশে তৈরি, মান কেমন

দেশে কারখানা চালু করার পর দুটো মডেলে ১২০ দিনে রিপ্লেসমেন্ট গ্যারান্টি (ত্রুটি দেখা দিলে বদলে দেওয়া) দিয়েছিল স্যামসাং। ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ফেরত আসার হার ছিল ১ শতাংশের অনেক কম। এটা খুবই ভালো নজির। তিনি বলেন, দেশে সংযোজনে মানের দিক দিয়ে কোনো হেরফের হয় না; বরং আরও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। 

এডিসন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকারিয়া শহীদ বলেন, ‘বাংলাদেশের কারিগরি কর্মীরা খুবই দ্রুত শিখতে পারে। আমাদের কারখানায় একজন বিদেশি কর্মীও নেই। মানের ক্ষেত্রেও আমরা ভালো ফল পাচ্ছি।’

 রপ্তানির সম্ভাবনা কতটুকু

দেশে তৈরি স্মার্টফোনের প্রথম চালানটি এ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে যাবে। রপ্তানিকারক ওয়ালটন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্র্যান্ড ওয়ালটনের কাছ থেকে স্মার্টফোন নিচ্ছে। ওয়ালটন দাবি করেছে, অরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার (ওইএম) হিসেবে ওই ব্র্যান্ডটিকে স্মার্টফোন তৈরি করে দিচ্ছে ওয়ালটন। ফলে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত ওয়ালটনের তৈরি স্মার্টফোনগুলো আমেরিকার বাজারে বিক্রি হবে।

সিম্ফনি দেশের চাহিদা পূরণ করে ২০২২ সালে রপ্তানি করার লক্ষ্য ঠিক করেছে। তারা মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে মুঠোফোন রপ্তানির সম্ভাবনা দেখছে। সিম্ফনি ভিয়েতনাম ও শ্রীলঙ্কায় ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে বলে জানান জাকারিয়া শহীদ। 

টেকনো ব্র্যান্ডের মুঠোফোন বাজারজাতকারী ট্রানশান বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী রেজওয়ানুল হক বলেন, চীনে খরচ অনেক বাড়ছে। সেখানে একজন শ্রমিকের মজুরি ৫০ হাজার টাকা। বাংলাদেশে ৮ হাজার টাকা। ফলে ভারত ও ভিয়েতনামের পাশাপাশি বাংলাদেশ মুঠোফোন তৈরির কেন্দ্র হতে পারে। 

 দুই পক্ষ

মুঠোফোনের কারখানা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতরে দুটি পক্ষ রয়েছে। এক পক্ষ উৎপাদনকারী, তারা চায় উৎপাদনকারী ও সংযোজনকারীর মধ্যে উচ্চ হারে কর পার্থক্য থাকুক। আরেক পক্ষ বলছে, কর ছাড় পেতে যন্ত্রাংশ উৎপাদনের যে শর্ত দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবসম্মত নয়। 

মুঠোফোনের একটি যন্ত্রাংশের নাম পিসিবি। শর্তানুযায়ী উৎপাদনকারী হতে হলে পিসিবি তৈরি করতে হবে। বিদেশি কয়েকটি ব্র্যান্ড বলছে, বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ড নিজেরা সবকিছু তৈরি করে না। তারা সংযোগশিল্পের মাধ্যমে তা তৈরি করিয়ে নেয়। কেউ তৈরি করে চিপসেট, কেউ এলসিডি, কেউ আবার ক্যামেরার লেন্সের ক্ষেত্রে দক্ষ। এ ক্ষেত্রে অ্যাপলের উদাহরণ দেন। বলেন, অ্যাপল সবকিছু তৈরি করিয়ে নেয়। নিজেরা করে না। 

ট্রানশান বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী রেজওয়ানুল হক বলেন, কেসিংয়ের একটি মোল্ডের দাম কোটি টাকা। একটি মোল্ড দিয়ে অন্তত ১০ লাখ কেসিং তৈরি না হলে খরচ উঠবে না। কেসিং, পিসিবি ইত্যাদি একেকটি যন্ত্রাংশ তৈরির জন্য একটি কারখানা হতে পারে, যেখান থেকে সবাই তৈরি করিয়ে নেবে। নীতিমালায় এ বিষয়টি থাকা দরকার। 

অবশ্য ওয়ালটন মোবাইলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এস এম রেজওয়ান আলম বলেন, দেশের বর্তমান কর–কাঠামো অনুযায়ী আমদানিকারকদের সঙ্গে সংযোজনকারীদের করভারের পার্থক্য ৩০ শতাংশ। কিন্তু সংযোজনকারীদের সঙ্গে উৎপাদনকারীদের কর ভারের পার্থক্য মাত্র ৫ শতাংশ। এর ফলে দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও নতুন আর কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। 

বল এখন সরকারের কোর্টে। 

রপ্তানিতে সবার আগে ওয়ালটন

দেশে এখন পর্যন্ত মুঠোফোন উৎপাদনকারী বা ম্যানুফ্যাকচারারের তালিকায় একমাত্র প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। ২০১৭ সালে গাজীপুরের চন্দ্রায় ওয়ালটন হেডকোয়ার্টার্সে মুঠোফোন কারখানা উদ্বোধন করা হয়। রপ্তানিতেও তারা এগিয়ে গেল।

ওয়ালটন জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে স্মার্টফোন রপ্তানি শুরু করছে। এই প্রথম ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত স্মার্টফোন আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি হবে। আমেরিকার একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ওয়ালটনের কাছ থেকে স্মার্টফোন নিচ্ছে। অরিজিনাল ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার (ওইএম) হিসেবে ওই ব্র্যান্ডকে স্মার্টফোন তৈরি করে দিচ্ছে ওয়ালটন।

 মুঠোফোন উৎপাদক ও সংযোজনকারীর মধ্যে পার্থক্য হলো, সংযোজক বিদেশ থেকে সব যন্ত্রাংশ আমদানির পর সংযোজন করে তা বাজারজাত করে। আর উৎপাদক কিছু যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে। ওয়ালটন জানিয়েছে, তারা মেকানিক্যাল ডিজাইন, মোল্ড, ফোন ও চার্জারের হাউজিং অ্যান্ড কেসিং, চার্জার, ব্যাটারি, পিসিবি, পিসিবিএ, মাদারবোর্ড ও ডিসপ্লে তৈরি করে। এ ছাড়া চার্জার, ব্যাটারি ও ইয়ারফোন তৈরি করে তারা।

ওয়ালটন বলছে, মুঠোফোন কারখানায় তারা প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৪ হাজার প্রকৌশলী ও কারিগরি কর্মীর। তাদের উৎপাদন ক্ষমতা মাসে ২০ লাখ ফিচার ফোন ও ৮ লাখ স্মার্টফোন। এর পাশাপাশি প্রতি মাসে ২০ লাখ চার্জার, ১০ লাখ ব্যাটারি ও ১০ লাখ ইয়ারফোন তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে তারা।

দেশে কারখানা চালুর পর এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ মুঠোফোন উৎপাদন ও বাজারজাত করেছে ওয়ালটন। এর মধ্যে রয়েছে ৪২টি মডেলের স্মার্টফোন। এর পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ইউনিট। আর ২৮টি মডেলের দেশে তৈরি ফিচার ফোন বাজারে ছাড়া হয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় ৪৩ লাখ ইউনিট।

২০১৯ সালে ওয়ালটন ১২ লাখের বেশি স্মার্টফোন ও ৪১ লাখ ৭৬ হাজারের কিছু বেশি ফিচার ফোন বিক্রি করেছে ওয়ালটন।

ওয়ালটন মুঠোফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এস এম রেজওয়ান আলম বলেন, দেশের বর্তমান কর–কাঠামো অনুযায়ী আমদানিকারকদের সঙ্গে সংযোজনকারীদের করভারের পার্থক্য ৩০ শতাংশ। কিন্তু সংযোজনকারীদের সঙ্গে উৎপাদনকারীদের করভারের পার্থক্য মাত্র ৫ শতাংশ। এর ফলে দেশে মুঠোফোন সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও নতুন আর কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না। এতে দেশের প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন শিল্প খাতের বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে।
প্র বাণিজ্য প্রতিবেদক 

দুটি কারখানা করছে সিম্ফনি

উৎপাদনসক্ষমতা বাড়াতে আরও দুই কারখানা করছে দেশীয় মুঠোফোন ব্র্যান্ড সিম্ফনির মালিক প্রতিষ্ঠান এডিসন গ্রুপ। নতুন করে তারা বিনিয়োগ করছে প্রায় ৭০ কোটি টাকা।

এডিসন গ্রুপ জানিয়েছে, নতুন কারখানায় তারা মুঠোফোনের যন্ত্রাংশ, চার্জার ও হেডফোন উৎপাদন করবে। এতে তাদের মূল্য সংযোজন আরও বাড়বে। এখন একটি কারখানায় তারা যন্ত্রাংশ সংযোজন করে মুঠোফোন তৈরি করছে।

এডিসন গ্রুপ ২০১৮ সালের নভেম্বরে তাদের প্রথম মুঠোফোন কারখানা চালু করে। এ কারখানাটি সাভারের জিরাবোতে। সেখানে উৎপাদিত স্মার্টফোন ও ফিচার ফোন এখন বাজারজাত করছে তারা। 

এডিসন গ্রুপের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী, বছরে দেশে ৩ কোটি ১০ লাখের মতো মুঠোফোন বিক্রি হয়। এর মধ্যে ২৪ শতাংশ স্মার্টফোন। বাকিটা ফিচার ফোন। সিম্ফনির দাবি, তারা বিক্রি করে ৮০ লাখের বেশি। স্মার্টফোনের বাজারে ১৮ শতাংশ ও ফিচার ফোনের ২৮ শতাংশ হিস্যা নিজেদের দখলে রাখার দাবি করেছে সিম্ফনি। 

এডিসন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকারিয়া শহীদ বলেন, এখন তাঁরা কোনো স্মার্টফোন আমদানি করছেন না। ফিচার ফোন আমদানি কমাতে এবং স্মার্টফোন উৎপাদন আরও বাড়াতে নতুন দুই কারখানা করা হচ্ছে। 

২০০৮ সালে জার্মানির সিমেন্স ব্র্যান্ডের মুঠোফোন ব্যবসা গুটিয়ে যাওয়ার পর সেখানকার কয়েকজন কর্মকর্তা সিম্ফনি ব্র্যান্ডের মুঠোফোন বাজারজাত শুরু করেন। সিমেন্সে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের বেশির ভাগই নতুন কোম্পানির বিভিন্ন পদে যোগ দেন। সিম্ফনি শুরুতে চীন থেকে নিজেদের ব্র্যান্ড নামে তৈরি করিয়ে এনে মুঠোফোন বিক্রি করত। তখন বাজারে তেমন কোনো বহুজাতিক ব্র্যান্ড ছিল না। সিম্ফনি ব্যাপক বাজার পায়। ২০১২ সালের শেষ দিকে দেশে তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা বা থ্রিজি চালুর পর কম দামে স্মার্টফোন সরবরাহ করে একচেটিয়া ব্যবসা করে সিম্ফনি। 

সরকার দেশে উৎপাদনে উৎসাহ দিতে নানা কর ছাড় দিলে ২০১৮ সালে সাভারের জিরাবোতে কারখানা করে এডিসন গ্রুপ। একই বছর ২৩ সেপ্টেম্বর কারখানা উদ্বোধন করা হয়। ডিসেম্বর থেকে সিম্ফনি ‘মেড বাই বাংলাদেশ’ নামে মুঠোফোন বাজারজাত করা শুরু করে। সব মিলিয়ে সিম্ফনিতে কাজ করেন ৯৮০ জন কর্মী, যাঁদের বেশির ভাগ কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত। 

এডিসন গ্রুপ জানায়, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে তারা ৮ একরের কিছু বেশি জমি ইজারা নিয়েছে। আশুলিয়ায় নিজস্ব প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার বর্গফুট জমিতে একটি কারখানা তৈরি করছে। এখনকার কারখানায় ৩০ কোটি টাকা, নতুন দুই কারখানায় ৭০ কোটি টাকা মিলিয়ে সিম্ফনির বিনিয়োগ দাঁড়াচ্ছে ১০০ কোটি টাকার মতো।
প্র বাণিজ্য প্রতিবেদক

স্মার্টফোন বিক্রিতে ১ নম্বর স্যামসাং

মুঠোফোন বিক্রিতে বিশ্বব্যাপী ১ নম্বর অবস্থানে দক্ষিণ কোরীয় কোম্পানি স্যামসাং। বাংলাদেশেও স্মার্টফোনের বাজারে তাদের অবস্থান ১ নম্বরে। দেশে কারখানা করে তারা গ্রাহকদের তুলনামূলক কম দামে স্মার্টফোন দিতে পারছে।

বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের কারিগরি সহায়তায় স্যামসাং ব্র্যান্ডের মুঠোফোন সংযোজনের কারখানা করেছে ফেয়ার ইলেকট্রনিকস। তাদের কারখানা ২০১৮ সালের জুনে যাত্রা শুরু করে। কারখানাটি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায়। 

ফেয়ার ইলেকট্রনিকস বাংলাদেশে স্যামসাংয়ের অন্যতম পরিবেশক। তাদের কারখানাটি তৈরি হয়েছে স্যামসাং ইলেকট্রনিকসের কারিগরি সহায়তায়। প্রায় ১৬ একর জমির ওপর এ কারখানায় ফেয়ার গ্রুপ বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এতে তারা স্মার্টফোনের পাশাপাশি স্যামসাংয়ের রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রসহ (এসি) বিভিন্ন গৃহস্থালি সরঞ্জাম তৈরি করে।

ফেয়ার ইলেকট্রনিকস ফেয়ার গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ফেয়ার গ্রুপ ২০০৮ সালে যাত্রা শুরু করে। ২০১৪ সালে তারা স্যামসাং মুঠোফোনের পরিবেশক হয়। এরপর স্যামসাংয়ের পণ্য তৈরির জন্য কারখানা করে। 

ফেয়ার ইলেকট্রনিকস জানায়, স্যামসাংয়ের ফোল্ডেবল (ভাঁজ করা যায়) মডেলের স্মার্টফোন ছাড়া বাকি সব মডেলেই দেশে সংযোজিত। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বিপণন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এখন মাদারবোর্ড তৈরির দিকেও এগিয়ে যাচ্ছেন। আগামী এপ্রিল অথবা মে মাস থেকে ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের কারখানায় মুঠোফোনের মাদারবোর্ড তৈরি হবে।
প্র বাণিজ্য প্রতিবেদক 

কারখানা করে ভালো করছে টেকনো

চীনের ট্রানশান হোল্ডিংসের টেকনো ব্র্যান্ডের মুঠোফোন দেশের বাজারে সুপরিচিত। এ ফোনও বাংলাদেশে সংযোজিত হয়। এখন তারা মাদারবোর্ডও তৈরি করছে।

দেশে টেকনো কারখানার যাত্রা শুরু করে ২০১৯ সালের শুরুতে। অবশ্য অনুমোদন পেতে পেতে লেগে যায় একই বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। কারখানাটি গাজীপুরের ভোগড়ায়। সেখানে কাজ পেয়েছেন প্রায় ৫০০ জন।

ট্রানশান বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী রেজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের শতভাগ ফোন এখন দেশে সংযোজিত। গত জানুয়ারি মাস থেকে আমরা সব মডেলের ফোনের মাদারবোর্ড তৈরি শুরু করেছি।’

টেকনোর তথ্য অনুযায়ী, তারা ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশে তাদের ব্যবসা রয়েছে। আফ্রিকায় তারা সেরা তিন ব্র্যান্ডের একটি। টেকনো মূলত ট্রানশানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। 

রেজওয়ানুল হক বলেন, ‘২০১৭ সালে টেকনো বাংলাদেশে কাজ শুরু করে। দেড় বছরের মাথায় কারখানা করে। আমরা বেশ ভালো করছি। সত্যি কথা বলতে কি, এতটা প্রত্যাশায় ছিল না।’

বাংলাদেশে টেকনোর কারখানা আর চীনে টেকনোর কারখানার মধ্যে পার্থক্য কী—জানতে চাইলে রেজওয়ানুল হক বলেন, ‘চীনের মতো অতটা উৎপাদনশীলতা আমরা অর্জন করতে পারিনি। কিন্তু মানের দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই।’ তিনি জানান, তাঁদের কারখানায় যে ৫০০ জন লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে, তাঁদের অনেকেই পোশাক কারখানায় অথবা মুঠোফোন মেরামতের কাজ করতেন। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের নিয়োগ করা হয়েছে।
প্র বাণিজ্য প্রতিবেদক

অপোও কারখানা করেছে এ দেশে

চীনা ব্র্যান্ড অপোর স্মার্টফোনও এখন বাংলাদেশে সংযোজিত হয়। দেশে অপোর স্মার্টফোন সংযোজন কারখানা করা হয়েছে গাজীপুরের ভোগড়ায়। কারখানাটিতে দুই শতাধিক মানুষ কাজ করেন।

অপোর কারখানাটি গত বছর অক্টোবরে চালু করা হয়। তারা জানিয়েছে, বছরে তাতে ১০ লাখ স্মার্টফোন সংযোজন করা যাবে। বাংলাদেশে স্মার্টফোন সংযোজন কারখানা করে এখন গ্রাহকদের হাতে আরও কম দামে মানসম্মত স্মার্টফোন তুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে বলে জানিয়েছে অপো।

নতুন কারখানায় সংযোজন করে এখন পর্যন্ত দুই লাখের বেশি স্মার্টফোন বাজারে ছেড়েছে অপো। বর্তমানে বাজারে থাকা সবকটি মডেলের স্মার্টফোনই বাংলাদেশে সংযোজন করা হচ্ছে। 

জানতে চাইলে অপো বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ডিরেক্টর আইয়োনো লিউ প্রথম আলোকে বলেন, অপো বাংলাদেশের স্মার্টফোন বাজারকে সব সময়ই গুরুত্ব দিয়ে আসছে। এখানকার স্মার্টফোন বাজার দারুণ সম্ভাবনাময়। দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। তাই এখন যাঁরা ব্যবহার করছেন, তাঁদের পাশাপাশি নতুন স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের হাতে আরও সাশ্রয়ী দামে মানসম্মত স্মার্টফোন তুলে দেওয়ার লক্ষ্যেই অপো বাংলাদেশে কারখানা করেছে।

অপো চীনের বাজারে ব্যাপক শক্তিশালী একটি ব্র্যান্ড। তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৪০টি দেশ ও অঞ্চলে অপোর ব্যবসা রয়েছে।
প্র বাণিজ্য প্রতিবেদক