জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, কর্মসংস্থান টানা কমেছে

গত দেড় দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ঘর থেকে ৮ শতাংশের ঘরে উন্নীত হয়েছে। কিন্তু এই সময়ে কর্মসংস্থানের
গতি টানা কমেছে। কলকারখানায় বার্ষিক কর্মসংস্থান অর্ধেকের বেশি কমেছে। পোশাকশিল্পের রপ্তানি বাড়লেও আগের মতো নতুন কাজের সুযোগ দিতে পারছে না।
যেমন ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর কলকারখানায় সাড়ে তিন লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। এ সময় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাংশের বেশি। আর ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কলকারখানায় বছরে দুই লাখের মতো কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ এ সময়ের গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ৭ শতাংশ।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জাতীয় কর্মসংস্থান কৌশলের খসড়ায় গত দেড় দশকের কর্মসংস্থান গতিপ্রকৃতিকে এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই ঘরানাকে ‘কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি’ হিসেবে ওই খসড়ায় বলা হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে এই খসড়া চূড়ান্ত করা হয়।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ নিয়ে বলেন, ‘বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থায় বাজার চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে না। শিক্ষিত তরুণদের চাকরি দিতে পারছি না। শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। চাকরির বাজারে যে ধরনের লোক দরকার, সেভাবে দক্ষতা বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা দিতে পারছে না। তাই বিদেশ থেকে লোক আনতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এখন অনানুষ্ঠানিক খাতে সিংহভাগ কর্মসংস্থান হচ্ছে। যেখানে যখন-তখন চাকরি চলে যেতে পারে, আবার ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা নেই।

কেমন ছিল দেড় যুগের কর্মসংস্থান
দেশে প্রবৃদ্ধি ক্রমশ বাড়লেও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি দিন দিন কমেছে। কর্মসংস্থানের কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, ২০০২-০৩ থেকে ২০০৫-০৬ অর্থবছরের মধ্যে প্রতিবছর ২ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান বেড়েছে। পরের পাঁচ বছরে তা বেড়েছে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ হারে। এরপরেই তা কমতে থাকে। ২০১০ সালের পরের তিন বছর ২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে এবং পরের চার বছর অর্থাৎ ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তা কমে হয় ১ দশমিক ৩০ শতাংশ হারে।

বিবিএসের পাঁচটি শ্রমশক্তি জরিপ ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০২-০৩ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশে ৯৮ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। ওই সাত বছরে প্রতিবছর গড়ে ১৪ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৬৭ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। ওই সময়ে বছরে গড়ে সাড়ে ৯ লাখ নতুন চাকরি হয়েছে।

তিন দশক ধরে এ দেশের কর্মসংস্থানের বড় খাত পোশাক কারখানা। নব্বইয়ের দশকে যে গতিতে এই খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে, এখন আর সেই গতি নেই। ১৯৮৯-৯০ থেকে ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে প্রায় ২৯ শতাংশ, তখন ওই খাতে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধিও হয়েছিল প্রায় ২৯ শতাংশ। এরপর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্থাৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি কর্মসংস্থান। ২০১০-১১ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মধ্যে রপ্তানিতে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ। এই সময়ে পোশাক খাতে ২ দশমিক ১৩ শতাংশ হারে বার্ষিক কর্মসংস্থান হয়েছে।

কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির ধরন বদলানোর পক্ষে মত দিয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অবশ্যই প্রবৃদ্ধির ধরন পাল্টাতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে সবার জন্য শোভন কাজের সৃষ্টি করতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনায় ২০৩১ সাল পর্যন্ত শ্রমঘন শিল্পকে প্রাধান্য দিয়েছে। বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ কী
বর্তমান কর্মসংস্থানের ধারা বজায় থাকলে আগামী ১০ বছর সাড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থানের সংকট মোকাবিলা করা যাবে না।

জাতীয় কর্মসংস্থান কৌশলের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রবৃদ্ধি বাড়লে নির্দিষ্ট পরিমাণ বাড়তি কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু শ্রমশক্তিতে থাকা বেকার এবং প্রতিবছর শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়া তরুণ-তরুণীদের চাকরির চাহিদা মেটাতে ওই বাড়তি কর্মসংস্থান পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া মৌসুমি বেকারের মতো উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তি তো আছে।

খসড়ায় বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরজুড়ে (২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর) প্রতিবছর গড়ে ১৭ লাখ ৬০ হাজার কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। ওই পাঁচ বছরে সাড়ে ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে কর্মসংস্থান নিয়ে তিন ধরনের ধারণা দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, সাড়ে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও যদি বর্তমান কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি (২০১৩ সালের পরের কর্মসংস্থানের ধারা, সবচেয়ে কম) অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০২৪-২৫ অর্থবছর নাগাদ প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হবে। তাহলে শ্রমবাজারে প্রতিবছর তরুণ-তরুণীরা ঢুকছেন, তাঁদের সবার কাজের সুযোগ মিলবে না।

>২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ১৪ লাখ কর্মসংস্থান।
পরের সাত বছর বার্ষিক গড়ে সাড়ে নয় লাখ কর্মসংস্থান।
কলকারখানায় বার্ষিক কর্মসংস্থান দুই লাখে নেমেছে।
পোশাকশিল্প আগের মতো চাকরি দিতে পারছে না।

দ্বিতীয়ত, ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের মতো কর্মসংস্থানের ধারা যদি থাকে, তাহলে বছরে ১৬ লাখ কর্মসংস্থান হবে। তৃতীয় সম্ভাবনায় বলা হয়েছে, অর্থনীতির ধরন যদি নতুন করে কিছু কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে সাড়ে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ১৭ লাখ ৪০ হাজারের বেশি কর্মসংস্থান হবে না। এর মানে, তখনো বেকার লোক থাকবেন।

২০২৫ সালে দেশের কত কর্মক্ষম থাকবেন, সেই হিসাবও দেওয়া হয়েছে। ২০২৪-২৫ সালে শ্রমশক্তিতে থাকবেন ৭ কোটি ৬১ লাখ কর্মক্ষম মানুষ। আগামী পাঁচ বছরে প্রতিবছর গড়ে ১৫ লাখ ৮০ হাজার তরুণ-তরুণী শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে। এ ছাড়া বর্তমানে ২৭ লাখ বেকার আছেন। প্রতিবছর গড়ে ৫ লাখ মানুষ কাজ নিয়ে বিদেশে যাবেন। এ ছাড়া প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যুক্ত থাকেন ৬ লাখ ১১ হাজার মৌসুমি বেকার, কম মজুরি পান এমন মানুষ। যাঁদের ‘উদ্ধৃত শ্রমশক্তি’ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

বর্তমান কর্মসংস্থানের ধারা বজায় থাকলে ২০২৬ থেকে পরের পাঁচ অর্থবছরে গড়ে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও কর্মসংস্থানের ঘাটতি পূরণ করা কঠিন হবে। ওই পাঁচ বছরে দুই ধরনের কর্মসংস্থানের ধারণা দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের কর্মসংস্থানের ধারা বজায় থাকলে প্রতিবছর যে তরুণ-তরুণী নতুন করে কাজের সন্ধানে নামেন, তাঁদের কর্মসংস্থান করা যাবে। কিন্তু ‘উদ্ধৃত শ্রমশক্তি’তে থাকা নারী-পুরুষের কাজের সংস্থান করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, কৃষি ও উৎপাদন খাতে যদি প্রযুক্তি বিকাশ ঘটে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ে; এতে কর্মসংস্থানের প্রবাহে ভাটা পড়তে পারে। তারপরও যদি ২০১০ থেকে ২০১৭ সালের কাছাকাছি কর্মসংস্থানের ধারা বজায় রাখা যায়, তবে ২০৩০ সালে উদ্ধৃত শ্রমশক্তিকে কাজে লাগানো যাবে।

সরকারের জাতীয় কর্মসংস্থান কৌশল খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধরন দিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের ঘাটতি মেটানো যাবে না। এমন প্রবৃদ্ধি হতে হবে যেখানে কর্মসংস্থান হয়। তিনি পরামর্শ দেন, জিডিপির প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান তৈরি করতে হলে শিল্পায়ন হতে হবে। তবে শুধু তৈরি পোশাকনির্ভর শিল্পায়ন নয়, আবার একটি খাতকে বছরের পর বছর প্রণোদনা দিয়ে শিল্পায়ন নয়। একটি সার্বিক শিল্পায়ন কৌশল ঠিক করতে হবে। সেই শিল্প যেন শ্রমঘন হয়। তাঁর মতে, একদিকে উদ্যোক্তা সৃষ্টি করতে সরকারি সহায়তা লাগবে, অন্যদিকে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পর্যাপ্ত অবকাঠামোও তৈরি করতে হবে।