আর্থিক খাতে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা আছে

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ফাইল ছবি
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ফাইল ছবি
>

ব্যাংক খাতে ঋণের সুদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আবার ৬ শতাংশের বেশি সুদে আমানত নিচ্ছে না ব্যাংকগুলো। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংকটে পড়েছে। এসব নিয়েই প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানাউল্লাহ সাকিব

প্রথম আলো: সরকার দীর্ঘদিন ধরে ঋণের সুদহার কমানোর চেষ্টা করছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে কীভাবে দেখছেন?

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: এটি পুরোপুরি ভুল সিদ্ধান্ত। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির (এফএসআরপি) পর বাংলাদেশ ব্যাংক সুদহার নির্ধারণ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এরপর নব্বইয়ের দশক থেকে প্রতিটি ব্যাংক নিজের মতো সুদহার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করত। এখন এসে সুদহার বেঁধে দেওয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই নিজের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে সরকার ঘোষণা দিয়ে বাজার অর্থনীতিতে চলে এসেছিল। এখন সেই নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এর ফল খুব খারাপ হতে পারে। পুরো আর্থিক খাতে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতির সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাজার অর্থনীতি ও নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি দুটি দুই রকম। এই দুটির যেকোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।

প্রথম আলো: তাহলে কি আপনি সুদহার কমানোর বিপক্ষে। সরকার তো বলছে, দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে সুদ কমাতেই হবে।

ইব্রাহিম খালেদ: সুদের হার কমানোর বিষয়ে আমি একমত। তবে সেটা জোর করে নয়। চার বছর আগে স্বাভাবিক নিয়মে সুদহার ৯ শতাংশে নেমেছিল। তাই সরকারকে বুঝতে হবে, জোর করে বা চাপিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক না। এতে সংশ্লিষ্ট খাতের ক্ষতি হয়। আর খেলাপি ঋণ যদি বাড়তে থাকে, তাহলে কোনোভাবেই সুদ কমানো সম্ভব না। নিয়মানুযায়ী, ঋণ খেলাপি হলে তার বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয়, মুনাফা থেকেই তা কেটে রাখা হয়। এসব বিষয় অবজ্ঞা করে চললে তার প্রভাব খুব খারাপ হবে।

প্রথম আলো: ব্যাংকগুলো আমানতে ৬ শতাংশের বেশি সুদ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার প্রভাব কী হতে পারে বলে মনে করেন?

ইব্রাহিম খালেদ: আমানতের সুদ ৬ শতাংশ করার ফলে মূল্যস্ফীতি সব খেয়ে ফেলবে। এর বাইরে ব্যাংকের মাশুল, কর আছে। ফলে গ্রাহকদের টাকা প্রকৃতপক্ষে কমে যাবে। তাতে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দিতে পারে। ব্যাংক টাকা না পেলে ঋণ দেবে কীভাবে? ফলে ৯ শতাংশ সুদ তো পরের কথা, ব্যাংকের ঋণ দেওয়াই কমে যাবে। আমার মনে হচ্ছে, ব্যাংকে সুদ কমায় অনেকে এমএলএম কোম্পানিতে টাকা রাখা শুরু করবেন। আবার গোপনে বিভিন্ন গ্রুপ গড়ে উঠবে, যারা ১০ শতাংশ সুদে টাকা নিয়ে তা পাচার করবে। সরকারকে সতর্ক করে বলতে চাই, সব জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে নেই। বাংলাদেশ ব্যাংককে ভূমিকা পালন করতে দিন।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংক কি তার ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করতে পারছে?

ইব্রাহিম খালেদ: ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে থাকেন শুধু শেয়ারহোল্ডার প্রতিনিধি। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব আমানতকারীদের স্বার্থ দেখা। কিন্তু এখন সরকার অনেক শক্তিশালী। তাই সরকারের চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক একেবারে ন্যুব্জ ও নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ভারতের দিকে দেখতে পারেন। সেখানকার গভর্নর দেশটির প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও শোনেননি। পদত্যাগ করে চলে গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার অনুযায়ী, আইনত সরকার বা কোনো মন্ত্রী কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশনা দিতে পারেন না। কিন্তু এই আইন ভঙ্গ করে এখন গভর্নরকে ডেকে নিয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ২ শতাংশ অর্থ এককালীন জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার যে প্রজ্ঞাপন বাংলাদেশ ব্যাংক জারি করেছে, তা অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়েছিল। এটা এমন একজন ব্যক্তি তৈরি করেছিলেন, যিনি ভালো বাংলাও জানেন না। তাই ইংরেজিতে করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা অনুবাদ করে জারি করেছে। এর চেয়ে অর্থনীতির ওপর বড় অত্যাচার আর কী হতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আর্থিক খাতের প্রকৃত তথ্য পাচ্ছেন না। তাঁকে ভুল পথে পরিচালনা করা হচ্ছে।

প্রথম আলো: ব্যাংকাররা বলছেন, এসএমই খাতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব না। আবার খেলাপি ঋণের পরিস্থিতিও খুব ভালো নয়।

ইব্রাহিম খালেদ: এসএমই খাতকে প্রাধান্য দিতেই ব্র্যাক ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করেছিল। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ১৬-১৭ শতাংশের কম সুদে ব্যাংকটি ঋণ দিতে পারে না। ছোট ছোট ঋণ দিতে অনেক মানুষকে কাজে লাগাতে হয়। কারণ প্রতিটি ঋণই যাচাই-বাছাই করে দিতে হয়। এখন ৯ শতাংশে ঋণ দিতে হলে এসএমই ও রিটেইল খাত থমকে যাবে। অনেকে বেকার হয়ে পড়বেন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।

প্রথম আলো: সমস্যায় পড়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংকে বাঁচাতে আদালত আপনাকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছিলেন। কেন পদত্যাগ করলেন?

ইব্রাহিম খালেদ: ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ে দায়িত্ব নিয়ে দেখলাম, সেখানে টাকা লুট করা হয়েছে।  এভাবে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকাই তছরুপ করা হয়েছে। এসব টাকা উদ্ধারের ক্ষমতা আমার নেই। তাই পদত্যাগ করেছি।