আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঋণপত্র

চট্টগ্রাম বন্দরে চলছে পণ্য ওঠানো–নামানোর কাজ
চট্টগ্রাম বন্দরে চলছে পণ্য ওঠানো–নামানোর কাজ

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য পরিশোধের একটি নিরাপদ মাধ্যম হলো ঋণপত্র বা লেটার অব ক্রেডিট (এলসি)। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে একটি সাধারণ বিষয় হলো, ক্রেতা ও বিক্রেতা ভিন্ন দেশে অবস্থান করবেন। তাই উভয়ের মধ্যে একটা আশঙ্কা বিরাজ করে। ক্রেতার একটা ভয় থাকে, পণ্য ঠিকঠাকমতো বুঝে পাবেন কি না, অন্য দিকে বিক্রেতার ভয় থাকে পণ্যের মূল্য পাবেন কি না। এই আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রপ্তানিকারক কর্তৃক রপ্তানি করা পণ্যের মূল্যপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আমদানিকারকের পক্ষে ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র বা লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলার প্রচলন হয়।

ঋণপত্র বা এলসিকে ইতালিয়ান ভাষায় বলে লেত্তেরা দ্য ক্রেদিতো। কিছু পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, সর্বপ্রথম মিসরের ও ব্যাবিলনের বণিকদের মধ্যে এই প্রচলন চালু হয়। ব্যবসা ও বাণিজ্য সচল রাখার জন্য প্রথম কখন ঋণ ব্যবহার করা হয়েছিল, তা জানা যায় না। ধারণা করা হয়, প্রাগৈতিহাসিক কোনো সময়ে এটির প্রচলন শুরু হয়। গ্রিক মহাকবি হোমারের এক লেখায় জানা যায়, সম্ভবত শিল্প, ব্যাংকিং, মুদ্রার প্রচলন, এমনকি আদি রূপে অর্থের প্রচলন হওয়ার আগেও ঋণের প্রচলন ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দের একটি প্রতিশ্রুতি মাটির মুদ্রা সংরক্ষিত আছে। সেটি কোনো ঋণের অর্থ পরিশোধের ছিল, এতে সুদের পরিমাণ পর্যন্ত যোগ করা ছিল। একই ধরনের আরেকটি প্রমাণ মেলে খ্রিষ্টপূর্ব ২৪৮ অব্দে, সেটি ছিল মিসরের। এটি প্রমাণিত যে প্রাচীন গ্রিসের ব্যাংক লেটার অব ক্রেডিট বা ঋণপত্র ইস্যু করে। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন ব্যাংকগুলোর ভূমিকা এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে যায়। ১২ ও ১৩ শতাব্দীতে জেনোয়া, ভেনিস, ফ্লোরেন্সসহ ইউরোপের অনেক শহর পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময় বণিকদের দুটি বড় সমস্যার মুখোমুখি হতে হতো—১. সোনা নিয়ে চলাফেরা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ২. বাণিজ্যের জন্য উৎপন্ন মুদ্রা, যা ব্যবসায়ীদের চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত ছিল না। এই সমস্যার সমাধানে বণিকেরা প্রাথমিকভাবে যা চালু করেন, তা ছিল বিনিময় বিল ও ঋণপত্র। বিনিময় বিলের পরিপূরক হিসেবে ঋণপত্র ব্যবহার করা হতো। অনেক পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, ১৩ শতাব্দীতে মার্কো পোলো ইউরোপে এই ব্যবস্থারও আরও বিকাশ ঘটান। পোলো একজন ভেনিসীয় পর্যটক ও বণিক। পশ্চিমাদের মধ্যে সর্বপ্রথম সিল্ক রোড পাড়ি দিয়ে চীন দেশে এসে পৌঁছানো লোকজনের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ইউরোপীয়দের কাছে চীনের তৎকালীন নাম ছিল ক্যাথে।

১৭ শতকের দিকে এলসি ছিল ইউরোপীয় মহাদেশ ও ইংল্যান্ডের সাধারণ আর্থিক উপকরণ। তখন এর কাজ ছিল অনেকটা ট্রাভেলার্স চেকের মতো। ১৯ শতকের দিকে এলসি ইস্যুর ক্ষেত্রে একচেটিয়া প্রাধান্য পাচ্ছিল ব্রিটিশ ব্যাংকগুলো। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে, ভ্রমণকারীরা সাধারণত ব্যাংক থেকে ইস্যু করা একধরনের ঋণপত্র নিয়ে ঘুরতেন, যার মাধ্যমে যাত্রাপথে যেকোনো ব্যাংক থেকে নগদ উত্তোলন করতে পারেন।

অতীতে এলসির বিভিন্ন টার্ম এবং ধারার ব্যাখ্যা নিয়ে দেশে দেশে বিরাজমান রীতিনীতি নিয়ে একটা বিবাদ দেখা যেত। ক্রেতা–বিক্রেতার মধ্যে বিরোধ কখনো কখনো মামলা–মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়াত। পরে আন্তর্জাতিক লেনদেন সহজ করতে প্যারিসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) অভিন্ন নিয়মকানুন প্রণয়নের কাজ হাতে নেয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে (১৯৩৩) তাদেরই উদ্যোগে প্রণীত হয় ইউনিফর্ম কাস্টমস অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস ফর ডকুমেন্টারি ক্রেডিট। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু মাথায় এনে নীতিমালা সংশোধন করা হয়েছে। প্রথমে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের ব্রোসিওর নম্বর ৫০০ ইউনিফরম কাস্টমস অ্যান্ড প্র্যাকটিসেস ফর ডকুমেন্টারি ক্রেডিটস (ইউসিপি) এখন পৃথিবীর সব দেশই অনুসরণ করতে একমত হয়। সর্বশেষ ২০০৭ সালে প্রকাশিত ইউসিপির বর্তমান সংস্করণটি আইসিসি পাবলিকেশন নম্বর ৬০০। এটি ইউসিপি-৬০০ নামে পরিচিত।