নারীর জন্য নারীর তৈরি অর্থনীতি

মুনিয়া ইসলাম কাজ করেন একটি সংবাদমাধ্যমের বিজ্ঞাপন বিভাগে। তাঁর সাড়ে পাঁচ বছর ও আট মাস বয়সী দুই বাচ্চা আছে। মুনিয়া যখন কাজে থাকেন, বাচ্চা দুটি থাকে সিদ্দিকাতুল হক নামের আরেকজন নারীর মালিকানার একটি দিবাযত্ন কেন্দ্রে। সেই দিবাযত্ন কেন্দ্রে কাজ করেন আরও ছয়জন নারী। এভাবে একজন কর্মজীবী নারী তাঁর পেছনে তৈরি করছেন আরও অনেক কাজের ক্ষেত্র, যেখানে কর্মসংস্থান হচ্ছে অন্য নারীদের।

অর্থনৈতিক কর্মে অংশগ্রহণে বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে আছেন অনেকটাই। এমনকি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণও নিশ্চিত করতে পারেনি নারীর কর্মসংস্থান। ২০১৯ সালে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার, ‘এশিয়া প্যাসিফিক এমপ্লয়েমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী নারীর বেকারত্বের হার পুরুষের চার গুণ এবং এই হাের উচ্চশিক্ষিত নারীই বেশি।

২০১৯ সালের মে মাসে প্রকাশ পাওয়া বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুেরার ‘জেন্ডার স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নারীর কর্মসংস্থান ৩৩.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৬.৩ শতাংশ হয়েছে। তবে এই বৃদ্ধির সিংহভাগ গ্রামীণ নারীর কর্মসংস্থান। শহুরে নারীর কর্মসংস্থান বরং কমেছে, ২০১৩–তে শহুরে নারীর কর্মসংস্থান ৩২.৯ শতাংশ ছিল, যা ২০১৪-১৫–তে কমে দাঁড়ায় ৩০.৮ শতাংশে। ২০১৬-১৭–তে এসে তা একটু বেড়ে ৩১ শতাংশ হয়। অথচ বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সে বছর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে লেখাপড়া করা জনগোষ্ঠীর ৪২ শতাংশ ছিলেন নারী।

সালসাবিলি জান্নাত খাবার মোড়কজাত করছেন
সালসাবিলি জান্নাত খাবার মোড়কজাত করছেন

কাজের ক্ষেত্রে এসে নারীরা ঝরে পড়েন, কিন্তু এর কারণ নিয়ে সঠিক কোনো গবেষণা হয়নি বলে জানান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র ফেলো নাজনীন আহমেদ। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়া, সন্তান রেখে কাজে যাওয়ার কোনো নির্ভরযোগ্য জায়গা সেভাবে তৈরি না হওয়া, সংসার ও সেবামূলক কাজের ভার নারীদের ওপর বেশি থাকাকেই নারীদের কর্মবিমুখতার কারণ মনে করেন তিনি। ‘আশার কথা হচ্ছে, এ নারীরা নিজেদের মতো কাজের ক্ষেত্র তৈরি করছেন এবং একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করছেন,’ বলেন নাজনীন।

ফেসবুকে জনপ্রিয় শাড়ির উদ্যোগ পটের বিবির কর্ণধার ফোয়ারা ফেরদৌস চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন গর্ভাবস্থায়। গর্ভাবস্থায় জটিলতা তৎকালীন অফিসের ছুটির শর্তের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পেরে চাকরি ছাড়তে হয় তাঁর। সন্তান জন্মের পরে মাত্র ২৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ঘরে বসেই পটের বিবির সূচনা করেন। পাঁচ বছর পর এখন পটের বিবির মাসিক আয় ছয় থেকে সাত লাখ টাকার মতো। আট মাস হলো লালমাটিয়াতে একটি আউটলেটও চালু করেছেন।

‘পটের বিবিতে আমার সঙ্গে কাজ করেন ৫০ জন মানুষ। সরাসরি ৪ জন নারী কাজ করেন, যাঁদের ২ জন অনলাইনে ব্যবসা দেখেন, আর ২ জন আউটলেট সামলান।’

নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ফেসবুক উদ্যোক্তা এই নারীরা এতই ছোট উদ্যোগ চালান যে তাঁদের হিসাব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই। কিন্তু এই সংখ্যাটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে, তাঁদের ছোটবেলায় শেখা কোনো জ্ঞান, ছোট হস্তশিল্প, সহজাত রান্নার দক্ষতা ইত্যাদি কাজে লাগিয়ে তাঁরা ঘরে বসে বাচ্চা লালনপালনের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছেন। ব্যবসা একটু বড় হলে একজন দুজন করে কর্মী নিয়োগ দিচ্ছেন। তাঁদের এই ছোট ছোট উদ্যোগগুলো দাঁড়িয়ে আছে একে অন্যের ওপরই। একজন হয়তো অফিসের কাজ সামলে রান্না সামলাতে হিমশিম খান অথবা রুচিমতো পোশাক তৈরি করতে সময় দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না—এভাবে নারীদের জীবনের টুকিটাকি অনেক অনুষঙ্গের জোগান দিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে একটি নারীনির্ভর অর্থনীতি, যার ক্রেতা–বিক্রেতা–কর্মী সব নারী।’

সন্তান রেখে কাজে যাওয়ার কোনো উপায় না পেয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন, এমন একজন নারী সালসাবিলি জান্নাত। একটি উন্নয়ন সংস্থার গবেষণার কাজ থেকে সালসাবিলি ছিটকে পড়েন সংসারে। ‘আমি অনেক দিন পর্যন্ত চেষ্টা করেছি বাড়ি থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার। কিন্তু পরে আর সম্ভব হয়নি,’ বলেন সালসাবিলি জান্নাত। বেশ কিছুদিন বসে থাকার পরে তিনি শুরু করেন একটি ফেসবুকভিত্তিক ক্যাটারিং সার্ভিস। প্রায় দুই বছর ধরে চলা এই সার্ভিস থেকে তাঁর মাসিক আয় ৬০ হাজার টাকার মতো।

নারীদের ঘরে বসে এই টুকটাক কাজে এগিয়ে আসাকে খুব ইতিবাচক মনে করছেন নাজনীন আহমেদ। তাঁর মতে, ‘এভাবে গৃহে নারীর মজুরিবিহীন কাজ আর বিনা মূল্যে থাকছে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের নারীরা ৭ দশমিক ৭ ঘণ্টা মজুরিবিহীন গৃহকর্ম করেন। এই কাজের উদ্বৃত্ত দিয়েই তাঁরা অন্য আরেকজন নারীর গৃহকর্মের বোঝা কমিয়ে আনেন, যিনি বাইরে কাজ করে আয় করেন।’

অর্থনীতিতে নারীদের এই বাস্তুসংস্থান (ইকোসিস্টেমের চেয়ে ভালো বাংলা পেলে করে নেবেন) যেমন অর্থনীতিকে গতিশীল করছে তেমনি নারীদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন করছে। এর সুফল সার্বিক উন্নয়ন এবং নারীর স্বাধীনতায় পড়বে বলে মনে করেন এই উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ।