করোনার পায়ে পায়ে মন্দার পদধ্বনি?

করোনাভাইরাস শুধু মানুষের শরীরেই নয়, অর্থনীতিতেও সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। ছবি: প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস শুধু মানুষের শরীরেই নয়, অর্থনীতিতেও সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। ছবি: প্রতীকী ছবি

নতুন করোনাভাইরাস, যা কোভিড-১৯ নাম পেয়েছে, তা শুধু মানুষের শরীরেই সংক্রমণ ঘটাচ্ছে না; এর ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বৈশ্বিক অর্থনীতিও। গত মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে বৈশ্বিক পুঁজিবাজারগুলোতে। মার্চের প্রথম সপ্তাহে এসে পরিস্থিতি যেখানে দাঁড়াচ্ছে, তাতে বৈশ্বিক জিডিপি চলতি বছর উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা।

করোনাভাইরাসের কারণে এরই মধ্যে আর্থিক বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে শঙ্কা। এটা এতটাই যে মানুষকে আশ্বস্ত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে সুদহার কমানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। আর্থিক বাজারে সৃষ্ট শঙ্কা ও পরিস্থিতি সামলাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন পদক্ষেপ নেওয়ার ঘটনা সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল ২০০৭-০৯ সময়ের অর্থনৈতিক মন্দার সময়।

গত ৩ মার্চ মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ নির্ধারিত সময়ের দুই সপ্তাহ আগেই বিশেষ সভা ডেকে সুদহার দশমিক ৫ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়েছে। একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। একই পথ অনুসরণ করছে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ড। অর্থবাজারে যে ধরনের ইঙ্গিত মিলছে, তা সত্য হলে মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার আরও কমাতে পারে। আর মরগ্যান স্ট্যানলির দেওয়া পূর্বাভাস মানলে, আগামী জুনের মধ্যে বৈশ্বিক গড় সুদহার দশমিক ৭৩ শতাংশে নেমে আসবে, যা চলতি বছরের শুরুতে ১ শতাংশ ছিল। আর গত বছরের শুরুতে ছিল ২ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, এই সুদহার হ্রাসের মাধ্যমে আর্থিক বাজারে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, পরপর কয়েকটি ধাক্কা সামলাতে গিয়ে আগেই এ হার অনেকটা কমানো হয়েছিল। ফলে বাজার চাঙা রাখতে সুদহার কমানোর নীতি অনুসরণের খুব বেশি সুযোগ নেই। হাতে যত বেশি বিকল্প থাকে, সংকট মোকাবিলা তত সহজ হয়ে যায়—এ কথা সবাই জানে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর হাতে এ ধরনের বিকল্প এখন কম। যুক্তরাষ্ট্রের হাতে কিছুটা বিকল্প থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। দীর্ঘস্থায়ী সংকটের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনকেও বিপাকে পড়তে হবে।

করোনাভাইরাস মূলত অর্থনীতির উৎপাদনব্যবস্থার গোড়াতেই আঘাত হেনেছে। শ্রম, পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ, সেবা খাত ইত্যাদি সবকিছুই এর দ্বারা আক্রান্ত। লোকেরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অভিভাবকদেরও ঘর-ছাড়ার সুযোগ থাকছে না। ইতালির উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বের কারখানা বলা যায় যে চীনকে, সেই চীনই এখন বলা যায় বিচ্ছিন্ন। পরিস্থিতি এমন যে বহু কর্মস্থল কোয়ারেন্টাইন অবস্থায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই যখন অবস্থা, তখন আবার চাহিদার ওপরও পড়ছে খড়্গ। কারণ, অসুস্থ ব্যক্তিরা বাজারে যাচ্ছেন কম, ফলে কিনছেনও কম। এটি আবার বিপরীত দিক থেকেও প্রভাব ফেলছে উৎপাদনব্যবস্থার ওপর। জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিবেচনাতেই কমিয়ে ফেলতে হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড।

না, করোনাভাইরাস থেকে যেতে আসেনি। শিগগিরই বিজ্ঞানীরা এর প্রতিষেধক হয়তো বাজারে নিয়ে আসবেন। মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায় হয়তো করোনা বিদায় নেবে। কিন্তু এর ফলে হয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক সংকট থেকে যাবে আরও কিছুকাল। সেই পরিস্থিতি এমনকি এখনকার চেয়ে খারাপও হতে পারে। কারণ, এই সময়ের মধ্যে বহু প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কমে গেলেও স্থির ব্যয়গুলো তাদের নির্বাহ করে যেতেই হবে। বিষয়টা অনেকটা অলস বসিয়ে বেতন দেওয়ার মতো। এতে করে অনেক কোম্পানির ট্যাঁকে টান পড়তে পারে। আর করোনা বিদায় নেওয়ার পর এসব কোম্পানি স্বাভাবিকভাবেই সংকট উতরাতে আটঘাট বেঁধে নামার চেষ্টা করবে। আর তখনই আর্থিক খাতের ওপর দ্বিতীয় আঘাতটি আসবে, যেহেতু অনেক প্রতিষ্ঠানই বিনিয়োগ ও ঋণের জন্য শরণাপন্ন হবে। পরিস্থিতি কতটা জটিল হতে পারে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জোট ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টসের দেওয়া একটি তথ্যেই স্পষ্ট। সংস্থাটি জানাচ্ছে, বিশ্বের ধনী দেশগুলোর ১২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেরই আয় তাদের করা ঋণের সুদ পরিশোধের মতো যথেষ্ট নয়।

সংক্রমণ ঠেকাতে জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে, যা প্রভাব ফেলছে অর্থনৈতিক উৎপাদনে। ছবি: এএফপি
সংক্রমণ ঠেকাতে জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে, যা প্রভাব ফেলছে অর্থনৈতিক উৎপাদনে। ছবি: এএফপি

এই যখন প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা, তখন শ্রমিকদের অবস্থাই–বা ভালো থাকে কী করে? শ্রম বেচে জীবন চালানো মানুষদের কত শতাংশের আর দীর্ঘ সময় পাড়ি দেওয়ার মতো সঞ্চয় থাকে? আয় কেন, চাকরি হারানোর চরম শঙ্কা ঘিরে ধরবে তাদের, যদিও তাদের নিত্যপণ্য কেনার দায় থেকে যাবে। গবেষণা সংস্থাগুলোর এমন গবেষণালব্ধ তথ্য প্রকাশের আগেই সাধারণ মানুষ এই আশু শঙ্কা বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছে। ফলে মানুষ ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে। এতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ বাড়ছে। অর্থাৎ বিষয়টি এক ভয়াবহ চক্র তৈরি করছে।

শুধু চীনের কথাই বলা যাক। সেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণেই দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে কমবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ১৯৭৬ সালে মাও সে–তুংয়ের মৃত্যুর পর এমন ঘটনা চীন দেখেনি। শুধু চীন কেন, বৈশ্বিক জিডিপিতে টান পড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে গোল্ডম্যান স্যাকস। এই অবস্থায় আরেকটি বৈশ্বিক মন্দা থেকে বাঁচতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো আর্থিক বাজারকে সচল রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশেষত ঋণ সরবরাহের হার ঠিক রাখার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো, যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের স্থির ব্যয় যথাযথভাবে নির্বাহ করতে পারে।

এ কারণে চীন ও জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের আর্থিক বাজারে বিপুল অঙ্কের অর্থ সরবরাহ করার কথা বলেছে। একই সঙ্গে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং নিজেদের পক্ষে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব নয়, এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিপদ কাটাতে সরাসরি আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কথাও বলেছে দেশ দুটির সরকার। দক্ষিণ কোরিয়া যেমন, কিছু ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর্মীদের পাওনা মেটাতে নগদ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে।

হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউর প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে বাজার অনেক ধরনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত পাওয়া ইঙ্গিত বলছে না যে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা অবশ্যম্ভাবী। আবার এমন শঙ্কাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই।

সত্য যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সংকট মোকাবিলায় আগের চেয়ে দ্রুত ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারগুলো সচেতন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এসব মিলিয়ে এবং মাত্র এক দশক আগের মন্দা মোকাবিলার অভিজ্ঞতায় আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দা হয়তো ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে, কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট থামানো যাবে না। তাই প্রস্তুত হওয়াটাই ভালো। আর সংকট মোকাবিলায় সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিবেচনাতেই প্রস্তুতি নেওয়া ভালো।