অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে

প্রবাসী আয় ছাড়া অর্থনীতির সব সূচক এখন নিম্নমুখী। করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক প্রভাবে গত মাসে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রধান দ্বার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য কমেছে। চীনে পণ্য রপ্তানি অস্বাভাবিক কমে গেছে। রাজস্ব আয়ে যে নেতিবাচক প্রভাব চলছে, সেটিতেও বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। কাঁচামালের সংকটে কারখানায় উৎপাদনও ব্যাহত হতে শুরু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসএসই বিভাগের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১১৮টি দেশ ও অঞ্চলে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং জনশক্তি, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির ৯৫ শতাংশ ও পণ্য রপ্তানির ৯০ শতাংশ বাজারে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। চীনে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বিশ্বজুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ায় জনশক্তি ও পণ্য রপ্তানি নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছে না।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাস যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে। আক্রান্ত দেশের মধ্যে চীনে রপ্তানি কমার অর্থ হলো, নতুন করে যেসব দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানেও সামনে রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, এসব দেশে মানুষের কেনার চাহিদা কমে গেছে। আর করোনাভাইরাস যাতে দ্রুত ছড়াতে না পারে, সেটিই এখন সবচেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কারণ, প্রাদুর্ভাবের ওপর জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির অবস্থা নির্ভর করে।

আমদানি-রপ্তানি কমছে

বন্দর দিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি-রপ্তানির পণ্য পরিবহন হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার কনটেইনার। এর আগে জানুয়ারি মাসে তা ছিল ২ লাখ ১২ হাজার কনটেইনার। আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ার আরেকটি আভাস হলো, বন্দর জেটিতে এখন অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা কম। 

বন্দরের তথ্যে দেখা যায়, প্রতি মাসে চীন থেকে সরাসরি গড়ে ১৫টি জাহাজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছে ৯টি। অর্থাৎ গত মাসে চট্টগ্রাম থেকে চীন রুটে জাহাজ কমার হার ৪০ শতাংশ। সরাসরি ছাড়াও সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার বন্দর থেকে কনটেইনার আসে চট্টগ্রামে। সেখানেও কমছে কনটেইনারের সংখ্যা। কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাকারী সি কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন আহমেদ সাহেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কার বন্দরগুলোতে ৮২টি জাহাজ চলাচল করত। এখন তা নেমে এসেছে ৭৫টিতে। প্রাথমিকভাবে সাতটি জাহাজ প্রত্যাহার করা হয়েছে। 

সমুদ্রপথে আমদানি বাণিজ্যের ৯৭ শতাংশই পরিবহন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। শুল্কায়নের পর এসব পণ্য খালাস করা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমসের হিসেবে দেখা যায়, গত মাসে মোট পণ্য খালাস হয়েছে ৭৬ লাখ টন, যা গত জানুয়ারি মাসের চেয়ে ১৭ লাখ টন কম।

চীনে ২৯ মাসে সবচেয়ে কম রপ্তানি

আমদানির তুলনায় চীনে রপ্তানি খুবই কম। এরপরও চীনে গত মাসে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪ কোটি ১৯ লাখ ডলার। মাসভিত্তিক হিসাবে, গত ২৯ মাসে এটিই সর্বনিম্ন রপ্তানি আয়। গত অর্থবছরের আট মাসে চীনে রপ্তানি হয়েছিল ৫৯ কোটি ৬১ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ৪৭ কোটি ডলারে। রপ্তানি আয় কমেছে ২১ শতাংশ। অর্থাৎ মোট রপ্তানি আয়ে যে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি (৪.৭৯ শতাংশ), তার চেয়ে চার গুণ বেশি কমেছে চীনে রপ্তানি।

চীনে পণ্য রপ্তানির ছোট একটি খাত হলো পাটখড়ির ছাই বা চারকোল। বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মির্জা শিপন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রভাবে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় দুই হাজার কনটেইনারের সমপরিমাণ পাটখড়ির ছাইয়ের স্তূপ পড়ে ছিল। আশার কথা, চীনে পরিস্থিতি উন্নত হওয়ায় এখন আবার সাড়া পাচ্ছি।’

উৎপাদন ব্যাহত

চীন থেকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমলেও এত দিন কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। আগের মজুত ও স্থানীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করে কারখানা সচল রেখেছেন উদ্যোক্তারা। তবে গত সপ্তাহ থেকে অনেক কারখানা কর্তৃপক্ষ উৎপাদন সময় কমিয়ে এনেছে। চীনের রপ্তানিকারকেরা নতুন চালানের কাঁচামাল সরবরাহ করতে শুরু করলেও তা এখনই পাচ্ছেন না কারখানার মালিকেরা। নতুন চালানের কাঁচামাল হাতে পেতে রপ্তানিকারকদের অপেক্ষা করতে হবে মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরু পর্যন্ত। তাতে এ মাসেই উৎপাদনমুখী খাতে প্রভাব পড়েছে।

নাছিরাবাদ শিল্প এলাকার ইনডিপেনডেন্ট অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব প্রথম আলোকে বলেন, চীন থেকে মার্চের প্রথম সপ্তাহে কারখানার কাঁচামাল কাপড় হাতে পাওয়ার কথা ছিল। এখন তা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে হাতে পাওয়া যাবে। এখনই কারখানার ১৪টি উৎপাদন লাইনের সাতটিই বন্ধ রাখতে হয়েছে। এপ্রিলের আগে কারখানার উৎপাদন পুরোদমে স্বাভাবিক হচ্ছে না। 

বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি এম এ ছালাম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের হিসাবে, কাঁচামালের সংকটে অনেক কারখানায় ২০-২৫ শতাংশ কাজ কম হচ্ছে। মার্চ মাসজুড়ে এই অবস্থা থাকবে।’ 

জনশক্তি রপ্তানিতে প্রভাব

আয় বাড়লেও প্রবাসে কর্মী পাঠানোর সংখ্যা দুই বছর ধরে কমছে। এখন আবার করোনাভাইরাসের প্রভাব সাময়িকভাবে এই খাতেও পড়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশের ভ্রমণকারীদের দেশটিতে প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে কুয়েত ও কাতার। তাতে দেশ দুটিতে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ রয়েছে।

বেসরকারি খাতের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সংগঠন বায়রার মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বজুড়ে যেহেতু করোনা ছড়িয়েছে, তাতে কিছুদিনের জন্য প্রভাব পড়বে। তবে তা সাময়িক। বরং দেশে যাতে বেশি ছড়িয়ে না পড়ে, সেদিকেই জোর দেওয়া উচিত। 

অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরুর প্রোগ্রাম পরিচালক মেরিনা সুলতানাও মনে করেন, এই ভাইরাসে আক্রান্তদের সুস্থ হয়ে ওঠার হার বেশি। প্রাদুর্ভাব সব সময় থাকবে না। তাতে এখন পর্যন্ত জনশক্তি রপ্তানিতে যে প্রভাব পড়েছে, তা সাময়িক বলে মনে হচ্ছে। 

রাজস্ব আয় কমছে

 রাজস্ব আয় এমনিতেই নিম্নমুখী। ফেব্রুয়ারিতে শুধু চীন থেকে আমদানি কমায় জানুয়ারির তুলনায় প্রায় ২২৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় কমেছে। আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আদায়ের বড় প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের আট মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১১ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা ঘাটতিতে আছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি খুব সামান্যই, দশমিক ৩ শতাংশ। 

এদিকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, স্বর্ণ, সার ও চিনি ছাড়া ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশির ভাগ পণ্যের দাম তুলনামূলক কমতির দিকে। মূলত বিশ্বজুড়ে চাহিদা কমায় আন্তর্জাতিক বাজার পড়ে গেছে। এতে বাংলাদেশের মতো আমদানিকারক দেশগুলো কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাবে। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় এই সুবিধা কতটুকু ঘরে তোলা যাবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।