করোনাভাইরাসের ঝুঁকি : মহাবিপদে অর্থনীতি

.
.

বিশ্ব অর্থনীতি চরম ঝুঁকির মধ্যে। আবার বিশ্ব অর্থনীতিকে বিধ্বস্তও বলা যায়। অনেকের আশঙ্কা ছিল, এবারের বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধের হাত ধরেই আসবে। কিন্তু সব ধারণা উল্টে দিয়েছে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। মিল একটাই, ভাইরাস ছড়িয়েছে চীন থেকেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গত ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে বিশ্বব্যাপী ছড়ানো মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। এরপর যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। লোক চলাচল যতটা কমানো যায়, প্রায় সব দেশ সে চেষ্টাই করছে। এককথায় বলা যায়, ‘সবকিছু বাতিল করো’—এই নীতিতে চলতে চাইছে এখন পুরো বিশ্ব। আর এতে বিশ্ব অর্থনীতির ওপর করোনাভাইরাসের প্রভাব যে বড় ধরনের হতে যাচ্ছে, তাতে আর সন্দেহ রইল না। শেষ পর্যন্ত প্রভাব কতটা, তা জানা যাবে আরও পরে। কেননা প্রতিদিনই পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। চীনে প্রকোপ কমলেও অন্য দেশগুলোতে ছড়াচ্ছে দ্রুতগতিতে। এখন পর্যন্ত ১১০টি দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।

বাণিজ্যযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব নিয়েই ২০২০ সালে প্রবেশ করেছিল বিশ্ব অর্থনীতি। চীনে ১ ডিসেম্বর করোনাভাইরাস শনাক্ত হলেও দেশটির সরকার তা প্রকাশ করে বছরের শেষ দিন, ৩১ ডিসেম্বর। শেষ দিকে তো অনেক বিশ্লেষকই বলতে চেষ্টা করছিলেন যে শেষ পর্যন্ত হয়তো বাণিজ্যযুদ্ধ মন্দা নিয়ে আসবে না। কিন্তু এখন আর তা বলার উপায় নেই। আবার এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে জ্বালানি তেল নিয়ে মূল্যযুদ্ধ। সুতরাং বিশ্ব অর্থনীতিতে যে আবারও একটি মন্দায় ঢুকছে, তাতে সন্দেহ কম।

বলা হচ্ছে যে স্বাস্থ্যঝুঁকির চেয়েও করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক বিপদ আরও বেশি। কেননা এর কারণে যত মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে বেশি মানুষ দেউলিয়া হবে। চাকরি হারাবে বহুসংখ্যক মানুষ।

অর্থনীতির কত ক্ষতি

ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব করার সময় এখনো আসেনি। কেননা প্রতিদিনই পরিস্থিতির বদল হচ্ছে। যেমন মার্চের প্রথম সপ্তাহে সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গের বিশেষজ্ঞরা হিসেব করলেন যে করোনাভাইরাস যদি শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়ায়, তাহলে বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষতি হবে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। এই অর্থ যুক্তরাজ্যের পুরো দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সমান। শেষ পর্যন্ত কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি আকারেই ছড়িয়েছে।

ধনী দেশগুলোর সংস্থা ওইসিডি মার্চেরই প্রথম সপ্তাহে বলেছিল, করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দশমিক ৫ শতাংশ কমবে। এখন বলছে, দেড় শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। আবার ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স এর আগে বলেছিল জিডিপি কমবে ১ শতাংশ। আর এখন তা শূন্যে নেমে আসবে কি না, সেই প্রাক্কলনের কথাও কেউ কেউ বলছেন। ২০১৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ। শেষ পর্যন্ত হয়তো ২০২০ সালের বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।

করোনাভাইরাসের প্রভাব দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজার, পর্যটনসহ বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় সব খাতে
করোনাভাইরাসের প্রভাব দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজার, পর্যটনসহ বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় সব খাতে

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) মার্চের প্রথম সপ্তাহে বলেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বিরাট ক্ষতির ঝুঁকিতে রয়েছে বিশ্ব। বৈশ্বিক উন্নয়ন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। বৈশ্বিক জিডিপি এ বছর শূন্য দশমিক ১ থেকে দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। আর আর্থিক ক্ষতি হতে পারে ৩৪ হাজার ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত।

অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা বৈশ্বিক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। তাতে দেখা যায়, নিম্ন মাত্রার মহামারি হলেও অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে ২ লাখ ৩০ হাজার (২.৩ ট্রিলিয়ন ডলার)। পরিস্থিতি বিপর্যয়কর হলে ক্ষতি হবে ৯ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের (৯.২ ট্রিলিয়ন ডলার)।

শিরোনামগুলো পড়লেই বোঝা যাবে অর্থনীতির মহাবিপদটি কতভাবে আসতে পারে। যেমন বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। শিরোনামটি হচ্ছে ২১ শতকের সবচেয়ে বড় পতন। অনেক দেশই তাদের দরজা আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে। এতে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ফ্লাইট। শিরোনাম হচ্ছে, বিশ্বের পর্যটনশিল্পে ১৯৮৭ সালের পরে ঘটেছে সবচেয়ে বড় পতন।

বাংলাদেশের কি হবে

বিশ্ব অর্থনীতির শেষ মন্দা এসেছিল ২০০৮ সালে। বেশ একটা আত্মতৃপ্তির মধ্যে ছিল বাংলাদেশ। বিশ্বমন্দা বাংলাদেশকে কিছুই পারেনি—এই বক্তৃতা শুনতে হয়েছে বহুদিন। তবে অর্থনীতিবিদেরা ঠিকই জানতেন যে সে সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে তেমন সংযুক্ত ছিল না। অন্যদিকে সেই বিশ্বমন্দা বাংলাদেশের উপকারেই লেগেছিল। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশ বেশ বিপাকেই ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে বিশ্বমন্দার সুবিধা পায়। সে সময় জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পায়, কমে যায় খাদ্যপণ্যের দাম।

করোনাভাইরাসের প্রভাব দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজার, পর্যটনসহ বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় সব খাতে
করোনাভাইরাসের প্রভাব দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজার, পর্যটনসহ বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় সব খাতে

২০২০ সালের পরিস্থিতি ভিন্ন। চীন থেকে শুরু হয়ে করোনাভাইরাস ইউরোপে ছড়াচ্ছে। ইউরোপ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার। মন্দার কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদা কমে গেলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বড় বিপাকে পড়ে যাবে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি বড় খাত প্রবাসী আয়। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দায় বিপদে পড়বে এই খাতও। আর দেশের মধ্যে সব চেয়ে বড় বিপদের নাম রাজস্ব খাত। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্লথ হয়ে পড়লে প্রভাব পড়বে রাজস্ব আদায়ে। এমনিতেই চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রবাসী আয় ছাড়া আর কোনো সূচকে ভালো খবর ছিল না। করোনাভাইরাসে বিশ্বমন্দা প্রকট হলে এবারও বাংলাদেশ বিপদমুক্ত থাকবে, এমনটি বলা যাবে না।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) বলেছে, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব মহামারি অবস্থায় গেলে এক বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৯ লাখ কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ক্ষতি হতে পারে ৩০২ কোটি ডলার। আর এতে বাংলাদেশে এক বছরে জিডিপির ক্ষতি হতে পারে ১ শতাংশের বেশি। আর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবা খাতে। এর পরিমাণ হতে পারে ১১৪ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। এ ছাড়া কৃষি খাতে ৬৩ কোটি ডলার, হোটেল, রেস্তোরাঁ ও এ-সংক্রান্ত সেবা খাতে প্রায় ৫১ কোটি ডলার, উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে প্রায় ৪০ কোটি ডলার এবং পরিবহন খাতে ক্ষতি হতে পারে সাড়ে ৩৩ কোটি ডলার।

তাহলে কী করতে হবে

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক কিংবা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বহুপক্ষীয় সংস্থাকে একটি টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। এই টাস্ক ফোর্সে অর্থনীতিবিদ, স্বাস্থ্য ও ভূরাজনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ২০ জন বিশেষজ্ঞ থাকতে পারেন বলে তিনি লিখেছেন।

করোনাভাইরাসের প্রভাব দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজার, পর্যটনসহ বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় সব খাতে
করোনাভাইরাসের প্রভাব দেখা যাচ্ছে শেয়ারবাজার, পর্যটনসহ বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় সব খাতে

পরিস্থিতি যত খারাপ হচ্ছে, অর্থনীতি নিয়ে উৎকণ্ঠাও তত বাড়ছে। একই সঙ্গে করণীয় নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। তবে প্রথম কাজটি হচ্ছে প্রাদুর্ভাব কমানো। আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) সম্প্রতি বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। বলা যায়, একটি কাঠামো তৈরি করে দিয়েছে। সেখানে মানুষ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও সামষ্টিক নীতি নিয়ে কিছু করণীয়র কথা রয়েছে।

জেমস বন্ড সিরিজের নতুন সিনেমার নামই ছিল ‘নো টাইম টু ডাই’। আর তাই আপাতত পিছিয়ে গেছে সিনেমাটি মুক্তির সব কাজ। থেমে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান, খেলা, ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় বড় ঘটনা। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের প্রভাবে এখন মৃত্যু ঠেকানো যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার উঠে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করা। সেটাই সামনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

যেসব নীতি নেওয়া যায়

মানুষের জন্য

শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য

সামষ্টিক নীতি

স্বাস্থ্য সেবায় সম্পদ বৃদ্ধি

ক্ষতিগ্রস্ত খাতের জন্য করের পরিমান
   কমানো বা পরিশোধ বিলম্বে করা

 

ব্যাংকের জন্য তারল্য বাড়ানোর ব্যবস্থা

ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য সাময়িকভাবে হলেও নগদ অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা

ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য তারল্য বৃদ্ধি ও ঋণ সরবরাহ বাড়ানো

মুদ্রা নীতির ব্যবস্থাপনা

 

স্বল্পকালীন কাজের সুযোগ সৃষ্টি

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সরকারি বকেয়া হ্রাস

সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি

সূত্র: ওইসিডি