করোনার ধাক্কা বিশ্বের ছোট-বড় সব অর্থনীতিতে

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যে সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা আর কারও অজানা নয়। এরই মধ্যে এখনকার সংকটকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মন্তব্য করেছেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল। বিশ্বনেতারা এটিকে নব্বইয়ের দশকের মন্দা ও সবশেষ ১৯৩০-এর মহামন্দার সঙ্গে তুলনীয় ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের ট্রিপল এফের (অর্থনীতি, জ্বালানি ও খাবার) সংকটের চেয়ে আলাদা করে দেখছেন।

গুণগত দিক থেকে এর আগের অর্থনৈতিক সংকটের তুলনায় এবারের সমস্যাটা একেবারেই আলাদা। গত তিন দশকের অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল মূলত মুদ্রানীতিকে ঘিরে। নোবেল পুরস্কারবিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজের মতে, এখনকার সংকটটি আর পাঁচটি সাধারণ অর্থনৈতিক সংকট নয়। এটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি অর্থনীতির জন্য পণ্য ও সেবার পরিমাণ নির্ধারণের বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থনীতি ও পুঁজিবাজারবিষয়ক গণমাধ্যম সিএনবিসিকে গত বুধবার দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিজ বলেছেন, ‘যাঁরা সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য সামনে আমাদের বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। এটিকে আপনি হেলিকপ্টার মানি (কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সরাসরি ব্যক্তিকে টাকা দিয়ে থাকে) বলতে পারেন।’

চীনের উহান শহর থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসটি ছোবল হেনেছে গোটা দুনিয়ায়। ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি কাছের দেশ শ্রীলঙ্কার মতো অনেক দেশ নিজেদের লকডাউন করার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে আগের দফায় বাংলাদেশসহ অনেক দেশে মন্দার ঢেউ না লাগলেও এবারকার পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা। ২০০৭-০৮–এর মন্দায় প্রবাসী আয় অব্যাহত ছিল। তাই এর প্রভাব স্থানীয়ভাবে পড়েনি। এবারের পরিস্থিতি একদম আলাদা। রপ্তানি বিশেষত তৈরি পোশাক আর চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় আর প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের ওপর ভর করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। বাংলাদেশের রপ্তানিতে করোনার ঢেউ যে লেগেছে, সেটা এরই মধ্যে স্পষ্ট। আর ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে সব ধরনের চলাচল মাসখানেকের জন্য নিষেধাজ্ঞা থাকায় সংকট যে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রবাসী আয়ের মূল উৎস সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ আর ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালি। চীন, ইরান আর দক্ষিণ কোরিয়ার পর করোনায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পর্যুদস্ত ইতালি। ফলে এসব দেশ থেকে সামনের মাসগুলোতে যে প্রবাসী আয় কমছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

জোসেফ স্টিগলিজ
জোসেফ স্টিগলিজ

কোথায় চলেছে দক্ষিণ এশিয়া

করোনা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে যাচ্ছে। ১৫ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে সেটা বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ এবং নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি। তাঁরা তিনজনই সংক্রামক ব্যাধি মোকাবিলার পাশাপাশি করোনার ফলে পর্যুদস্ত অর্থনীতিকে কীভাবে চাঙা করা যায়, সে জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন।

কলম্বো ও মালের কূটনৈতিক সূত্রগুলো এই প্রতিবেদককে বলেছে, এ বছর পর্যটন নিয়ে যে পরিকল্পনা করেছিল সেটা যে ভেস্তে গেছে, তা ওই দুই দেশ নিশ্চিত। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা গত দুই বছরে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও গির্জায় জঙ্গি হামলার কারণে পর্যটন ব্যবসায় পিছিয়ে ছিল। এবার তা পুষিয়ে নিতে বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছিল। বিশেষ করে ঋণে জর্জরিত হওয়ার কারণে দেশটি পর্যটনে এবার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। কিন্তু এখন শ্রীলঙ্কা সরকার ঋণের কিস্তি সামাল দেবে নাকি প্রণোদনা দেবে, সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। মালদ্বীপ তাদের অর্থনীতির প্রধান খাত পর্যটনে চলতি বছর ধসের আভাস পাচ্ছে। নেপালও চলতি বছর পর্যটনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। দেশটি মনে করছে, ভূমিকম্পের ধকল কাটিয়ে পর্যটনের ব্যাপারে যে পরিকল্পনা ছিল, সেটা এ বছর বাস্তবায়ন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করে ভারতের অর্থনৈতিক পত্রিকা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বৃহস্পতিবারের এক প্রতিবেদনে লিখেছে, করোনাভাইরাস চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে যদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, পরের তিন মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। জানুয়ারি-মার্চ সময়কালে ভারতে প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৩ এবং এপ্রিল-জুনে তা ৪–এ নেমে আসবে।

বৈদেশিক সহায়তা ও তেলের দামে ছাড় এবং কর্মী ছাঁটাই

করোনার কারণে জাপানের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। টোকিওতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টোকিওতে অনুষ্ঠেয় গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক আয়োজনের বিষয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭–ভুক্ত দেশের নেতারা গত মঙ্গলবার স্কাইপেতে যুক্ত হন। এ সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অলিম্পিক পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। জোটের অন্য নেতারা জাপানকে অলিম্পিক বাতিলের পরামর্শ দেন। শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি জি-৭ নেতারা।

২৪ জুলাই থেকে অনুষ্ঠেয় টোকিও অলিম্পিক বাতিল হলে জাপানের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, অলিম্পিককে কেন্দ্র করে গত কয়েক বছরে অবকাঠামোতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা হয়েছে। তাই অলিম্পিক বাতিল হলে ওই বিনিয়োগ পুষিয়ে আনতে জাপানের অন্তত ৫ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে।

জাপানের কূটনীতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটি বৈদেশিক উন্নয়ন সহায়তা (ওডিএ) কাটছাঁট করতে পারে। এটি ঘটলে বাংলাদেশের মতো জাপানের অংশীদার দেশগুলো সংকটে পড়তে পারে। কারণ, ওডিএর আওতায় মেট্রোরেল প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে জাপান। এতে করে মেট্রোরেলের প্রথম প্রকল্পে টাকা ছাড় হলেও পরের ধাপের অর্থায়ন বিলম্বিত হতে পারে।

এদিকে তেলের দাম নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পেট্রোলিয়াম উৎপাদনকারী দেশগুলোর জোটের (ওপেক) দর-কষাকষি চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ১৩ থেকে ১৯ ডলারে নামা নিয়ে দুই পক্ষের ওই সংঘাত। শেষ পর্যস্ত ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ২০ ডলারের নিচে নেমে এলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে লোকজন, বিশেষ করে বিদেশিরা চাকরি হারাবে। অনিবার্যভাবে এতে করে বাংলাদেশের মতো জনশক্তি রপ্তানিকারক দেশগুলোর ওপর প্রথম ধাক্কাটা আসবে।

তেলের দামকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মসংস্থানের যেমন সংকট তৈরি হতে পারে, করোনার কারণে এরই মধ্যে সংকটে পড়ে গেছেন বাংলাদেশের নাগরিকেরা। ফলে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ, বিশেষ করে ইতালি ও যুক্তরাজ্য থেকে প্রবাসী আয়ের কারণে ২০০৭-০৮–এ যে ধাক্কা বাংলাদেশে আসেনি, এবার সেটা আসার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে ইউরোপের বাজারে রপ্তানির ধাক্কা তো এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

মাইক্রোসফট করপোরেশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে বলেছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে উন্নতি ঘটলেও শাটডাউন অন্তত পরের ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করে বিল গেটস বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর কথা ভেবে আমি উদ্বিগ্ন হচ্ছি। কারণ, ওই সব দেশের লোকজন উন্নত দেশের মতো সামাজিকভাবে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেন না। তা ছাড়া সেখানকার হাসপাতালগুলোর সামর্থ্যও যথেষ্ট সীমিত।

মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি
মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মানীয় ফেলো, সিপিডি

জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে প্রভাবটা দুই স্তরে পড়বে। প্রথমত, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে পড়বে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় অর্থনীতি অভ্যন্তরীণভাবে সংকটের মুখোমুখি হবে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার কারণে স্বল্প কিংবা মধ্য মেয়াদে তা আমাদের অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্ব অর্থনীতির লকডাউনের ফলে আমাদের আমদানি, রপ্তানির পাশাপাশি অভিবাসন ও সেবা খাত দারুণভাবে ব্যাহত হতে শুরু করেছে। এটা ঠিক যে আমাদের আমদানির প্রধান উৎস চীনের পরিস্থিতির উন্নতি হলেও সরবরাহের ক্ষেত্রে বিশেষ করে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা কিন্তু এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। তাই পোশাক রপ্তানিতে এরই মধ্যে সংকটের আভাস দেখা যাচ্ছে। আর বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে রপ্তানি কমে যাওয়ার ফলে সরবরাহ খাত, সেবা খাত, পর্যটনসহ সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রেও অনিবার্যভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। চূড়ান্তভাবে এটি দেশের প্রবৃদ্ধি শ্লথ করে দেবে আর বেকারত্ব বাড়াবে। এই সংকট ছয় মাসের বেশি দীর্ঘ হলে অভ্যন্তরীণভাবে দাবিদাওয়া বাড়বে।

মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, এই পরিস্থিতিতে সরকারের আর্থিক ও মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে সমন্বয় আনা জরুরি। আর সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য এটা চ্যালেঞ্জও বটে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক খাতকে প্রণোদনা দিতে হবে। অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী জোরালো করাটা বাঞ্ছনীয়।