কী হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের বাজারে

ঘাটতি নেই, তবু দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে তোলা। ছবি: সৌরভ দাশ
ঘাটতি নেই, তবু দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ থেকে তোলা। ছবি: সৌরভ দাশ

চীনে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরুর পর বিশ্বজুড়ে ভোগ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করে। করোনা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় পাম, সয়াবিন তেল, গমসহ কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দামে পতন থামেনি। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশেও আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম কমতে শুরু করে। এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। তবে বাংলাদেশের বাজার সব সময় বিশ্ববাজারের মতো চলে না। দাম বাড়া-কমার জন্য এখানে অভ্যন্তরীণ কারণও অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। তারই চিত্র দেখা গেল দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে। হঠাৎ ভোগ্যপণ্যের দামে উত্থান শুরু হয় এখানে।

শুরুটা হয়েছিল করোনাভাইরাসে দেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর। মানুষজন প্রথমে জীবাণুনাশক ও মাস্ক কেনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। গত বুধবার করোনায় প্রথম মৃত্যুর সংবাদের পর ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্বাভাবিক চাপ তৈরি হয়। বহু ক্রেতা বাজারে গিয়ে এক-দুই মাসের জন্য বাজার সেরে নিয়েছেন। খুচরা দোকানে মজুত শেষ হতে থাকায় খুচরা বিক্রেতারা পাইকারি বাজারে থেকে বাড়তি পণ্য কেনা শুরু করেন। সরবরাহ ব্যবস্থায় এই চাপ থেকে দামও বেড়ে যায়।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) গত শুক্রবার খুচরা বাজারদরের যে হিসাব দিয়েছে, তাতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় ১৬টি পণ্যের দাম বাড়ার তথ্য রয়েছে। কেজিপ্রতি ২ টাকা থেকে শুরু করে ৬০ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ার তথ্য আছে বাজার প্রতিবেদনে। এ তালিকায় আমদানিনির্ভর পণ্য যেমন আছে তেমনি দেশে উৎপাদিত পণ্যও রয়েছে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে আদা, রসুন, পেঁয়াজ, তেল কী নেই? 

তবে রাজস্ব বোর্ড পণ্য আমদানির যে হিসাব দিচ্ছে, তাতে এখন পর্যন্ত কোনো ঘাটতি নেই। যেমন, মসুর ডাল, আদা, রসুন, পাম তেল, গম সবই গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের আট মাসে বেশি আমদানি হয়েছে। পেঁয়াজ আমদানি বেশি না হলেও দেশে ফলন উঠছে। ভারত থেকেও আমদানি শুরু হয়েছে। উৎপাদননির্ভর ভোগ্যপণ্যেও দুঃসংবাদ নেই। সরবরাহ চ্যানেলেও পণ্য আসছে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারেও এসব পণ্যের দাম বাড়েনি। এরপরও কেন বাড়ছে দাম?

খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মিঞা মার্কেট ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস জানাচ্ছেন, পেঁয়াজ, রসুন ও আদা—এ তিনটি পণ্য এক দিনে কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। দাম বাড়ার ক্ষেত্রে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এমন গুজব বেশি প্রভাব ফেলেছে। যদিও এসব পণ্যের কোনোটিতেই সরবরাহে ঘাটতি নেই। চালের দামও বেড়েছে এ সময়। চাক্তাই ধান-চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম প্রথম আলোকে জানান, এক-দুই মাসে যা বিক্রি হওয়ার কথা, তা তিন-চার দিনে বিক্রি হয়ে গেছে। পাইকারি বাজারেও গত কয়েকটা দিন ডানে-বাঁয়ে তাকানোর সুযোগ ছিল না। কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রতি বস্তায় পাইকারিতে কেজিপ্রতি তিন টাকা বেড়েছে চালের দাম।

পরিচিত ক্রেতারা জানিয়েছেন, কয়দিন পরে ঘর থেকে বের হওয়া যাবে কি না, এমন আশঙ্কা থেকেই অন্তত দেড়-দুই মাসের বাজার করেছেন তাঁরা। স্বাস্থ্যঝুঁকির সময় খাদ্য ঝুঁকিতে যাতে পড়তে না হয়, সে জন্যই সজ্ঞানেই তাঁরা বাড়তি জিনিসপত্র কিনেছেন।

বাজারে দাম বাড়ার তালিকায় আছে পাম ও সয়াবিনের দামও। অথচ বিশ্বব্যাংক ও মালয়েশিয়ান পাম অয়েল কাউন্সিলের হিসাবে গত জানুয়ারিতে যে পাম তেল বিক্রি হয় টনপ্রতি ৮১০ ডলারে, তা বৃহস্পতিবার বিক্রি হয়েছে ৫০৪ ডলারে। সয়াবিন তেলও ৮৭৫ ডলার থেকে নেমে সর্বশেষ বিক্রি হয়েছে ৬৯০ ডলারে। এই ভোজ্যতেলের দামও বেড়েছে খুচরায়।

বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ার জন্য সরবরাহ, চাহিদা, ফলন বা আবহাওয়ার পূর্বাভাসের মতো যে উপাদানগুলো প্রভাব ফেলে বাংলাদেশে, তার চেয়েও অনেক বেশি উপাদান প্রভাব ফেলে। এর উদাহরণও আছে ভূরি ভূরি। এবারের দাম বাড়ার নেপথ্যে আছে অনিশ্চয়তা, আতঙ্ক আর গুজবের মতো বিষয়।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, অনিশ্চয়তা থেকে বাজারে অস্বস্তিকর চাপ পড়েছে। এতে ভোগ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে, কোন পণ্যের কেমন মজুত, আমদানি ও সরবরাহ কেমন, তা সুনির্দিষ্টভাবে প্রচার করা। তা না হলে এই প্রবণতা আরও কিছুদিন থাকবে। তবে এ সময় নিত্যপণ্যের বড় রকমের কোনো ঘাটতি যাতে না হয়, সে জন্য দেশীয় পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো এবং আমদানি পণ্য আসছে কি না, তা তদারকি দরকার।