করোনার কালে স্টার্টআপের করণীয়

‘আমরা তো দিনে আনি, দিনে খাই। শুধু নিজে খাই না, আমাদের বড় একটা কর্মিবাহিনীকেও খাওয়াতে হয়। লোকে যদি আমাদের সেবা বা পণ্য না কেনে, তাহলে আমাদের অবস্থা হবে সবচেয়ে শোচনীয়’—বলছিলেন এক উদ্যোক্তা। কিন্তু তাঁদের টিকে থাকতে হবে। মাসে মাসে বেতন দিতে হবে। কর্মীদের মনোবল অটুট রাখতে হবে।

২০১৫ সাল থেকে বাসাবাড়ি বা অফিসের নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবা, যেমন ক্লিনিং, ইলেকট্রিক, প্লাম্বিং, ইলেকট্রনিক সামগ্রী সার্ভিসিংসহ যাবতীয় সেবা দিচ্ছে হ্যান্ডিমামা। এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী শাহ পরান জানালেন, তাঁদের সঙ্গে ঢাকা শহরের দুই হাজারের বেশি পেশাদার ক্লিনার ও অন্যান্য সার্ভিস টেকনিশিয়ান যুক্ত রয়েছেন। তাঁরা যেন নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে পারেন, সে জন্য ৪০ জন পূর্ণকালীন কর্মীকে সর্বদা তৎপর থাকতে হয়। শাহ পরান বললেন, যেহেতু সেবা প্রদানকারীরা সশরীরে উপস্থিত থেকে তাঁদের সেবা প্রদান করে থাকেন, করোনা ভাইরাসের কারণে ব্যবহারকারীরা এখন সেবা গ্রহণ থেকে বিরত থাকছেন। এতে করে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেবা প্রদানকারীরা। এ অবস্থা চলতে থাকলে থেমে যাবে নিম্ন আয়ের এ মানুষগুলোর জীবন।

শুধু হ্যান্ডিমামা নয়, বিক্রয় ও সেবার পরিধি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন স্টার্টআপের। এই সময়টাতে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে নিজেদের টিকিয়ে রাখা। এ জন্য ‘টিম হিসেবে টিকে থাকা এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে অনলাইনে গ্রাহকদের সেবা দেওয়ার বিষয়টি’ প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে মনে করেন গ্রামীণফোন এক্সিলারেটেরের প্রধান মিনহাজ আনোয়ার। এ জন্য কর্মীদের যথাসম্ভব বাসা থেকে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। নিজেদের মধ্যে অনলাইন মিটিং এবং গুগল ডকসের মতো টুলস ব্যবহার করে দলিলাদি তৈরি ও বিতরণে মনোযোগ দিতে হবে।

এ সময় কর্মীদের মনোবল অটুট রাখা এবং তাঁদের সাহস জোগানোর কাজটা এগিয়ে নিতে হবে। লাইট ক্যাসল পার্টনারসের অন্যতম পরিচালক ও অ্যানজেল বিনিয়োগকারী শওকত হোসেন কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা কোনোভাবেই চিন্তাতে আনা যাবে না বলেই মনে করেন। তিনি জানান, জাপানি এক মন্দাকালে সবাই যখন কর্মী ছাঁটাই করছিল, তখন সনি ইলেকট্রনিকস কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। পরে সেই সব দক্ষতা অনেক কাজে লেগেছে। কর্মীদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি মমতা ও আনুগত্য বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণ। অনলাইনে কর্মীরা যাতে ঘরে বসেই প্রশিক্ষণ নিতে পারেন, সে জন্য উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

নবীন উদ্যোক্তারা সবাই বলছিলেন আর্থিক সমস্যার কথা। আগামী কয়েক মাসে পণ্য বা সেবার বিক্রয় কমে গেলে কর্মীদের নিয়মিত বেতন দেওয়ায় সমস্যা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে শওকত হোসেন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা নিয়ে কর্মীদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করার পরামর্শ দিয়েছেন। সহজ ডট কমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মালিহা কাদির খরচ কমানোর জন্য খুব দরকারি নয়, এমন খাতগুলো চিহ্নিত করে সেই খাতে খরচ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। পাশাপাশি নিতান্তই দরকার হলে সবার জন্য আপৎকালীন বেতন কাঠামোর পক্ষে তিনি।

যেসব স্টার্টআপ খাবার-দাবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের অনেকেরই চাহিদা বাড়তে পারে। এ সময় তাই বাড়তি নজর দিতে হবে স্বাস্থ্য সচেতনতার। বাড়িতে তৈরি করা আচার ও গ্রোসারি পণ্যের স্টার্টআপ চুইঝালের ব্যবসা প্রধান জাহিদুল ইসলাম জানালেন, তাঁরা উৎপাদনে ১০০% হাইজিন মেইনটেন করার চেষ্টা করছেন। প্রত্যেক টিম মেম্বারের আলাদা হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ডওয়াশ, গ্লাভস, হেয়ার ক্যাপ ও মাস্ক পরে কাজ করার পাশাপাশি দুজন কর্মীর মাঝখানে একটি ফাঁকা চেয়ার রাখছেন। এতে সব সময় ৩ ফুট দূরত্ব বজায় থাকছে।

যেসব প্রতিষ্ঠান হোম ডেলিভারির সঙ্গে যুক্ত, তাদের ডেলিভারিম্যানের জন্য জীবাণু প্রতিরোধক জামা ও অন্যান্য ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। 

বাসা-বাড়ি থেকে কাজ করা এবং ক্রমবর্ধমান অনলাইন কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার প্রধান প্রাণই হলো নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা। এ সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। স্থানীয় ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী (আইএসপি) উদ্যোক্তাদের জন্য কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন আইএসপি অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি আমিনুল হাকিম। কর্মীদের জোন ভাগ করে দিয়ে নিজ বাসা থেকে সেবা দেওয়া, তাঁদের কাজ অনলাইনে মনিটরিং করা, গ্রাহকদের কানেকটিভিটি পর্যবেক্ষণের জন্য অনলাইন টুলের ব্যবহার বাড়ানো এবং ফাইবার কাটা পড়া বা লাইন ঠিক করার জন্য যেসব কর্মী ঘর থেকে বের হবেন, তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবহারের ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

এই বৈরী সময়ে টিকে থাকার পাশাপাশি নিজেকে বিকশিত করার জন্য চিন্তাভাবনায় সময় দিতে বলেছেন সবাই। শওকত হোসেন বললেন, অনেক সময় দৈনন্দিন কাজের চাপে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ভাবার ফুরসত থাকে না। প্রতিষ্ঠান বড় করার জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে ভাবার একটা সময় এখন পাওয়া যাবে।