কোভিড-১৯-এর যুগে ঋণসংকট

জয়তী ঘোষ
জয়তী ঘোষ

কোভিড-১৯–এর মতো বৈশ্বিক মহামারির যেমন ধ্বংসাত্মক দিক আছে, তেমনি সচেতনতা সৃষ্টিকারী দিকও আছে। সেটা হলো, এটি জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়। এ রকম ছোঁয়াচে রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটলে সমাজের সবচেয়ে সুরক্ষিত অভিজাত মানুষদেরও অবহেলিত মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে অবশ্যই উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার। সবচেয়ে অরক্ষিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবার গুরুত্ব অস্বীকার করে বেসরকারীকরণ ও খরচ কমানোর ওকালতি যাঁরা করেছেন, তাঁরা এখন বুঝবেন, এতে নিজেদের ঝুঁকিই তৈরি হয়েছে। কারণটা হলো, সমাজের স্বাস্থ্য নির্ভর করে সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর।

ইদানীং আরও যেটা ঘটেছে সেটা হলো, কোভিড-১৯-এর অর্থনৈতিক প্রভাব আরও মারাত্মক হতে পারে। এমনকি বিশ্বজুড়ে মন্দা শুরু হয়ে যেতে পারে। সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে, কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে; পুরো এলাকা অবরুদ্ধ করা হচ্ছে, শ্রমিকেরা জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন—এসব কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি কেবল বাড়বেই।

এই মহামারির আরেকটি অনালোচিত দিক নিয়ে তেমন মাথাব্যথা না থাকলেও গুরুত্বের দিক থেকে তা অনেক বড়। ব্যাপারটা হলো, এর প্রভাবে আর্থিক খাত আরও ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে। যার অর্থ হলো, ঋণসংকট এবং তার চেয়েও বড় আর্থিক ধসের সম্ভাবনা। একসময় পরিস্থিতির উন্নতি হবে, এই লক্ষ্যে যেসব নীতি প্রণীত হচ্ছে বা হবে, তা–ও বাস্তবায়িত হবে, মানুষও অন্তত কিছুটা ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য কাজে ফিরবে। কিন্তু আর্থিক ও ঋণসংকটের নিষ্পত্তি না হলে প্রকৃত অর্থে অর্থনীতি এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারবে না।

কোভিড-১৯–কে ‘ব্ল্যাক সোয়ান ‘বা হঠাৎ সৃষ্ট বিপর্যয় বলা হলেও এই আর্থিক সংকটের শুরু কিন্তু আরও অনেক আগে। ২০০৮ সালের আর্ক সংকটের পর উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে যেভাবে ঋণের বোঝা বেড়েছে, তাতে এটা অনেক দিন ধরেই বোঝা যাচ্ছিল, ছোটখাটো ঘটনাও সুদূরপ্রসারী অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বৈশ্বিক অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থার জন্য কত বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। ২০১৮ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্মিলিত ঋণ—সরকারি, বেসরকারি, অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক—সর্বকালের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। বিশেষ উদ্বেগের কারণ হচ্ছে, আর্থিক খাতবহির্ভূত করপোরেশনগুলোর ঋণ। উন্নয়নশীল দেশগুলোর তিন-চতুর্থাংশ ঋণই হচ্ছে এখন এসব প্রতিষ্ঠানের। আঙ্কটাডের তথ্যমতে, এই অন্তর্নিহিতভাবে ভঙ্গুর ‘বিদেশি ছায়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর’ কারণেই ঋণ এতটা বেড়েছে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে উন্নয়নশীল দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের এক-তৃতীয়াংশ বিদেশি মুদ্রায় নেওয়া। সেই ঋণ দিয়েছে আবার বিদেশি ঋণদাতারা।

আরও খারাপ খবর হলো, স্বল্পমেয়াদি আন্তর্জাতিক বন্ডের সার্বভৌম ঋণ পরিশোধ কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে। সমস্যা হচ্ছে, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে পুঁজি পাচারের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, এই সময় যদি আবার বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার আরও বিপন্ন হয়ে পড়বে।

আর্থিক খাতের এই অবস্থা সবচেয়ে ভালো সময়েও উদ্বেগের কারণ হতে পারে। আর সামান্যতম অর্থনৈতিক ঝাঁকুনিতেও এটি বিপর্যয় ঘটাতে পারে। কিন্তু আমরা এখন এক মারাত্মক ঝাঁকুনির মধ্যে আছি। এশিয়ার উদীয়মান অর্থনীতির কথা ভাবুন, তারা কোভিড-১৯-এর কেন্দ্রস্থল চীনের সঙ্গে আর্থিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা সংযুক্ত থাকার কারণে খুবই অরক্ষিত। রপ্তানির নাটকীয় হ্রাস, কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের সরবরাহ ঘাটতি, ভ্রমণশিল্পের দ্রুত অবনমন—এসব কারণে এশিয়া অঞ্চলে বেকারত্ব বাড়ছে। তার সঙ্গে ঋণসংকটের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।

এখন কথা হলো, এসব সমস্যা একটি দেশের পক্ষে নীতি প্রণয়ন করে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। বৈশ্বিক সমাজের এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বেশি করে নেতৃত্ব প্রয়োজন। সমন্বিত রাজস্ব নীতিমালার পাশাপাশি আমাদের এখন আসন্ন ঋণসংকট মোকাবিলা করতে হবে। এখন তাই ঋণ পুনর্গঠন করে ঋণসংকট মোকাবিলা করতে হবে।

ক্রমবর্ধমান ঋণের এই সমস্যা মেটাতে তুর্কি অর্থনীতিবিদ সাবরি ওনসুর ১৯৫৩ সালের লন্ডন ঋণ চুক্তির দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দেন। এই চুক্তির বদৌলতে জার্মানির অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন হয়। তখন জার্মানির সঙ্গে ২০টি বাহ্যিক ঋণদাতা সংস্থার চুক্তির বলে জার্মানির যুদ্ধপূর্ব ঋণের ৪৬ শতাংশ এবং যুদ্ধোত্তর ঋণের ৫২ শতাংশ বিলোপ হয়। বাকি ঋণ স্বল্প সুদের দীর্ঘমেয়াদি ঋণে পরিণত হয়। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ শর্ত ছিল এই যে তাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকলেই কেবল ঋণ পরিশোধ করতে হবে। পরিশোধিত ঋণ বার্ষিক রপ্তানি আয়ের ৩ শতাংশের বেশি হবে না। ফলে হলো কি, জার্মানির ঋণদাতারাও দেশটির রপ্তানি আয় বাড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে ঋণসংকট মোকাবিলার এ ধরনের ভবিষ্যৎমুখী ও সমন্বিত কৌশল থাকতে হবে। এর বিকল্প নেই।

ঈষৎ সংক্ষেপিত, জয়তী ঘোষ: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক। 
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন