বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?

>মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব থেকে অর্থনীতিকে রক্ষা করতে এখনই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বিশ্বের প্রায় দেশ। উদ্বিগ্ন সবাই। নেওয়া হচ্ছে নানা ধরনের পুনরুদ্ধার কর্মসূচি। বাংলাদেশ কী করবে। সরকারের কী প্রস্তুতি। সামনে কিন্তু কঠিন সময়।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সবকিছু করোনাভাইরাসের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার একটা ভালো সুযোগ পেয়েছেন। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থনীতির একটি সূচক ছাড়া আর কোনোটাই তেমন ভালো ছিল না। এক প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করে ছিলেন অর্থমন্ত্রী। বহু বছর এ রকম দুরবস্থা দেখা যায়নি। এ থেকে উত্তরণের জন্য যে ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কথা বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, তার কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। অর্থনীতি নিয়ে, অর্থমন্ত্রীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা বাড়ছিল।

এ রকম এক সময় দেখা দিল বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি এখন মহাবিপদে। বিপর্যস্ত অর্থনীতি। যে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা এসে গেছেই বলা যায়। এখন তাহলে বাংলাদেশ কী করবে। অর্থনীতি বাঁচাতে সরকাররের কী করা উচিত। সঠিক নেতৃত্ব বা ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনাটা কী।

করোনাভাইরাস নিয়ে এরই মধ্যে বিশ্ব নানা ধরনের শিক্ষা নিয়েছে। সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে, যে দেশ আগেভাগে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবস্থা নিয়েছে, তারাই বেশি সফল হয়েছে। তবে প্রাদুর্ভাব ঠেকানোই এখন একমাত্র কাজ নয়। বড় বিপদ আরও সামনে। আর সেই বিপদ আসবে অর্থনীতিতে। আর তাই সারা বিশ্বই এখন অর্থনীতি নিয়েও প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে।

অর্থনীতির ক্ষতি কত হবে, তার চূড়ান্ত পরিসংখ্যান মিলবে আরও পরে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এরই মধ্যে বলে দিয়েছে, বিশ্বের আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাবে। চীনে করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমেছে। দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির উপাত্ত প্রকাশ করেছে। যেমন গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি—এই দুই মাসে চীনের উৎপাদন কমেছে সাড়ে ১৩ শতাংশ, খুচরা বিক্রি কমেছে সাড়ে ২০ শতাংশ আর নির্মাণকাজ কমেছে সাড়ে ২৪ শতাংশ। এই অবস্থায় অর্থনীতি আগের অবস্থায় দ্রুত ও সহজে ফিরিয়ে যে আনা যাবে না, তা পরিষ্কার।

বিশ্বের সব সব দেশই এখন চিন্তিত অর্থনীতি নিয়ে। কারণ, এয়ারলাইনস খাত একপ্রকার বসেই আছে। সারা বিশ্ব পর্যটকশূন্য। খাদ্যপণ্য ছাড়া অন্য সব পণ্যের বিক্রি কমে গেছে। দেশগুলোর মধ্যেও যাতায়াত কমে যাওয়ায় অনেক পরিবহন ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। রাস্তাঘাট মানুষশূন্য, রেস্তোরাঁরও একই অবস্থা। বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও সেবা খাত বিপর্যস্ত। যেকোনো অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ছোটরা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোক্তারা নতুন করে দাঁড়াবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আর সারা বিশ্বেই ধস নেমেছে শেয়ারবাজারে। এই অবস্থায় সংকট থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বের প্রায় সব দেশই পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। নানা ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ।

কিন্তু বড় কোনো আলোচনা নেই বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশও বড় ক্ষতির মুখে। মনে রাখা দরকার, সামনে দুটি ঈদ আছে, শ্রমিকদের বেতন-বোনাস আছে। আর আছে বাজেট। সুতরাং প্রস্তুতি প্রয়োজন নানা দিকের।

অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ নিয়ে বললেন, এ মুহূর্তে দরকার, যারা এখন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া। করোনাভাইরাসের প্রভাবের কারণে যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বিশেষ করে শহরের ছোট ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা কমে যাচ্ছে। একমাত্র সুলভ মূল্যে ওএমএসের পণ্য ছাড়া তাঁরা কোনো সরকারি সহায়তা পান না। সরকারি সুবিধা পেতে লবিং করার মতো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই, তাদের দিকে এ মুহূর্তে নজর দেওয়া উচিত। কাজের অভিজ্ঞতা থাকায় এ ক্ষেত্রে এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করতে পারে। এ ছাড়া স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। তাঁর মতে, সামনে দুটি ঈদ আছে, তখন পোশাকশ্রমিকদের বোনাস কীভাবে দেওয়া হবে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, কিছুদিন পর থেকে করোনার প্রভাব অর্থনীতিতে কতটা পড়বে, তা বোঝা যাবে। যেহেতু বাংলাদেশের অর্থনীতি বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বৈশিক মন্দা দেখা দেবেই। ফলে বাংলাদেশের ওপরও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। তবে এখনই প্রস্তুত হতে হবে। অন্য দেশ কী করছে, তা বিচারবিশ্লেষণ করতে হবে। 

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বৈশ্বিক পরিকল্পনা
করোনাভাইরাস এখনো ছড়াচ্ছে। এর মধ্যেই বিশ্বব্যাপী ভাইরাস প্রতিষেধকের পাশাপাশি অর্থনীতির প্রতিষেধক নিয়েও আলোচনা শুরু করেছে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বিশেষ জরুরি তহবিল গঠনের কথা জানিয়েছে।

ভূমিকা রাখছেন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানেরাও। তাঁরা মানুষকে আপাতত নিরাপদ থাকত বলছেন, বাসায় থাকতে বলছেন। সমস্যা হচ্ছে বাসায় বসে থাকলে ব্যবসা বা চাকরির কী হবে। এ নিয়েও আশ্বস্ত করছেন তাঁরা। নানা ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা বলছেন। চাকরি হারালে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ সরকার থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে কোনো কিছু কি কেউ শুনেছেন? করোনোভাইরাস বিষয়ে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের প্রস্তুতি ছিল সামান্য। হয়তো সরকার অন্য কাজে ব্যস্ত ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু নীতিসহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এখন দরকার একটি সামগ্রিক ও সমন্বিত পরিকল্পনা। 

একটা দিকনির্দেশনার খোঁজে
সরকারগুলোর কী ধরনের নীতি নেওয়া উচিত, তা নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। ধনী দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি বা আইএলওর একটি গাইডলাইনও আছে। সবকিছু মিলিয়ে ফোর্বসে এ-সংক্রান্ত একটি লেখা ছাপা হয়েছে। মূলত সেটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হলেও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হলো বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।

১. সবার আগে প্রয়োজন স্বাস্থ্যগত সংকট মেটানোর ব্যবস্থা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমানো এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটি যত ছড়াবে, ক্ষতি তত বাড়বে। আর সেই ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারে সময়ও তত লাগবে। সাধারণ মানুষকে রক্ষা করা হচ্ছে এ মুহূর্তের প্রথম অগ্রাধিকার।

২. শিল্প, কলকারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—প্রায় সবই বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষ কাজে যেতে পারছে না। ক্রেতা নেই বাজারে। এখন সরবরাহজনিত সমস্যার চেয়ে চাহিদাজনিত সমস্যাটাই বেশি প্রকট। সুতরাং এখন চাহিদা বাড়াতে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। এ জন্য আয়ের প্রতিস্থাপন দরকার। বিশেষ করে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষজনের ক্ষেত্রে। এসব মানুষের সঞ্চয় থাকে না। তাদের হাতে অর্থ পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন। আর হোটেল রেস্তোরাঁসহ পর্যটন-সম্পর্কিত খাতে দরকার পুনরুদ্ধার বা বেইল-আউট কর্মসূচি।

৩. অনিশ্চয়তা অর্থনীতির বড় শত্রু। এই অনিশ্চয়তার জন্য মানুষ পণ্য মজুত করবে এবং ভবিষ্যতের জন্য কম ব্যয় করবে। ব্যবসায়ীরাও অনিশ্চয়তায় থাকলে অর্থনৈতিক মন্দা আরও ঘনীভূত হয়। ‘প্যানিক বাই’ আতঙ্কের কেনাকাটায় পণ্য সরবরাহ হ্রাস এবং মূল্যবৃদ্ধি যাতে না ঘটে, সেটিও দেখা প্রয়োজন। আর দরকার যে খাতগুলো এই মুহূর্তে বিপদে আছে, তাদের জন্য দ্রুত সহায়তার ঘোষণা।

৪. আয়ে বৈষম্য একটি প্রকট সমস্যা। সন্দেহ নেই এবারের সংকট আয়ে বৈষম্য আরও বাড়াবে। এ বিষয়টা সরকারকে মাথায় রাখতে হবে এখন থেকেই। এর সঙ্গে জড়িত আছে আইন শৃঙ্খলার বিষয়টি। 

৫. করোনাভাইরাসের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। তাতে আতঙ্ক বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। সরকার উদ্বিগ্ন হবে, সেটাও স্বাভাবিক। তবে এ জন্য এখনই শেয়ারবাজার চাঙা করতে অর্থের সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা হবে একটি ভুল পদক্ষেপ।

এই কাজ বাংলাদেশেও করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা হচ্ছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচির জন্য সামনের দিনগুলোতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। এখন সেই পরিকল্পনা করাটাই হবে সঠিক কাজ।

৬. একটা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। সরকার কোথায় পাবে এই অর্থ। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং এডিবি তহবিল গঠন করেছে। সেই তহবিল থেকে অর্থ পেতে পারে সরকার। দেশের ভেতর থেকে অর্থ সংস্থানের জায়গাও সরকারকে খুঁজে বের করতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানো একটি পথ। যদিও অর্থবছরের শুরু থেকেই আয় তেমন বাড়ছিল না। এখন তো সংকট আরও বেশি। সরকার উন্নয়ন ব্যয় কমাতে পারে। বিশেষ করে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের গতি কমিয়ে দিলে অর্থের সাশ্রয় হবে। যদিও অর্থবছর শেষে উন্নয়ন ব্যয় কমানো একটি নিয়মিত কাজ। সরকারকে চলতি ব্যয়ও কমাতে হবে। কমাতে হবে কম গুরুত্বপূর্ণ খরচ। কৃচ্ছ্রসাধন হবে অর্থ সাশ্রয়ের আরেক পথ। আরেকটি পথ হচ্ছে টাকা ছাপানো। তবে এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি।

কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তও নিতে হবে সরকারকে। কী ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে, সেই রূপরেখাও তৈরি করতে হবে। মানুষের হাতে সহায়তার অর্থ পৌঁছে দেওয়ার প্রক্রিয়া ঠিক করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য কী ধরনের সহায়তা প্রয়োজন, তা-ও বের করতে হবে। ইউরোপের দেশগুলোর মতো সরকার কি ‘ক্রেডিট গ্যারান্টি’ দেবে নাকি প্রথাগত সেই ‘রিফাইন্যান্সিং’ প্রথায় যাবে, তা-ও ব্যাংকগুলোকে বলতে হবে। নতুন পরিস্থিতিতে সরকারের রাজস্ব নীতি আর বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির সমন্বয় কীভাবে হবে, সেটিও ভাবতে হবে।

৭. দ্রুত একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। ভারত অর্থমন্ত্রীকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স করেছে। বাংলাদেশে কমিটির প্রধান কে হবেন, সেটা একটি প্রশ্ন বটে। তবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, একটি মন্ত্রিপরিষদের উপকমিটি গঠন করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা দরকার। এই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ভেতরে অবশ্যই আর্থসামাজিক ব্যবস্থাপনার যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোকে সম্পৃক্ত রাখতে হবে এবং তাদের ওপরে যথোপযুক্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এই কমিটিকে গতিশীল রাখার জন্য প্রতিদিনকার তথ্যপ্রবাহের একটি পর্যবেক্ষণব্যবস্থা থাকতে হবে। একই সঙ্গে তাদের ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পারার ক্ষমতাও থাকতে হবে। এ জন্য আমার প্রস্তাব হচ্ছে, সবচেয়ে ভালো হয় যদি একটি ক্যাবিনেট সাবকমিটি তৈরি করা হয়। এর সঙ্গে সমর্থন দেওয়ার জন্য একটি ছোট্ট গ্রুপ সঙ্গে থাকতে পারে। এটা খুব দ্রুততার সঙ্গে করতে হবে। এ রকম কিছু গঠন করলে এতে মানুষের মধ্যে আস্থা বাড়বে।

এখন দেখা যাক, সরকারের পদক্ষেপগুলোর কথা কত দ্রুত আমরা জানতে পারি।