শ্রমজীবী মানুষেরা কোথায় যাবেন

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

দেশের কোটি কোটি ‘দিন আনে দিন খায়’ মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি বিপদে আছেন। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে তাঁরা যাবেন কোথায়?

তাঁদের দুশ্চিন্তা, সংসার কীভাবে চলবে? করোনায় তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, ভবিষ্যতে হবেন। তাঁদের অনেকের রোজগার ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকের বন্ধ হওয়ার উপক্রম। পর্যাপ্ত রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাও তাঁদের কাছে কখনোই পৌঁছায় না। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় স্বল্প পরিসরে যে উদ্যোগগুলো আছে, সেখান থেকেও ঠিকমতো সুবিধা পান না তাঁরা। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত এই অসহায় শ্রমজীবীদের সুরক্ষা দিতে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা নেই।

করোনায় দেশের সবকিছু প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ—সবই বন্ধ। শহর-গ্রামনির্বিশেষে দিন আনে দিন খায় অসহায় মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এই অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরাই সবচেয়ে বেশি বেকার হয়ে গেছেন কিংবা হতে যাচ্ছেন। জীবিকার সন্ধানে তাঁরা রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে এসেছিলেন। সবকিছু বন্ধ হওয়ায় উপায়ান্তর না দেখে তাঁদের অনেকেই এখন গ্রামে ফিরে গেছেন। ঘাম ঝরানো রাজধানী এখন তাঁদের কাছে বড় বেশি পর হয়ে গেছে।

ঘরে থাকলে খাবেন কী? সংসার চলবে কীভাবে? তাই শ্রমজীবী লোকজন গ্রামমুখী।
রাজধানীসহ বড় বড় শহরের রিকশাচালক, গৃহকর্মী, বাস-টেম্পোচালকসহ হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। রাজধানীর বহু গৃহকর্মীকে কাজে আসতে বারণ করা হয়েছে। রিকশা নিয়ে বেরোতে পারছেন না রিকশাচালকেরা। তাঁরা গ্রামে যাচ্ছেন নতুন কাজের সন্ধানে। কিংবা পরিবার–পরিজনের সঙ্গে থাকতে চান।

শ্রমজীবীর সংখ্যা কত

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ (২০১৭) অনুযায়ী, দেশের ৮৫ শতাংশ কর্মজীবী লোক এমন অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দেশে মোট ৬ কোটি ৮ লাখ লোক মজুরির বিনিময়ে কোনো না কোনো কাজে আছেন। এর মধ্যে ৫ কোটি ১৭ লাখ ৪ হাজারই এমন অনানুষ্ঠানিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ (কাজের নিশ্চয়তা নেই) কাজ করেন। অন্য ব্যক্তিরা অনানুষ্ঠানিক খাতের। করোনায় অবশ্য তাঁদের জীবিকাও হুমকিতে আছে।

দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমজীবী লোকের মধ্যে কৃষি খাতে আছেন ২ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার নারী-পুরুষ। শিল্প খাতে ১ কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার লোক কাজ করেন। আর সেবা খাতে আছেন ১ কোটি ৭০ লাখ লোক।

এই অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীরা তৈরি পোশাক কারখানা কিংবা অন্য কোনো রপ্তানি খাতের কলকারখানার মতো প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন না। ওই সব রপ্তানিমুখী কারখানার শ্রমিকদের জন্য সরকার বেতন–ভাতার ব্যবস্থা করলেও অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের জন্য আপাতত কোনো ঘোষণা নেই।

কীভাবে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বাসের চালক ও সহকারী সাধারণত দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন। ১০ দিন বাস বন্ধ থাকলে তাঁরা কোনো মজুরি পাবেন না। একই অবস্থা কৃষিশ্রমিকদের। তাঁরা খেতখামারে কাজ করতে না পারলে মজুরি মিলবে না। একই দশা রিকশাচালকদের। তাঁদের বেশির ভাগই রিকশা দৈনিক ভিত্তিতে ভাড়া করেন। ভাড়ার টাকা মিটিয়ে বাকিটা নিজের আয়।

কী করতে হবে

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে অনানুষ্ঠানিক খাতের বিশাল শ্রমজীবী গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কিন্তু সরকারের দিক থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারের উচিত, কালবিলম্ব না করে তাঁদের সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধি করা, কিন্তু সামাজিক সুরক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দ দিন দিন মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ও বাজেটের আনুপাতিক হারে কমছে। তিনি মনে করেন, যত বেশি পারা যায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী লোকজনকে সুরক্ষার আওতায় আনতে হবে। টাকার পাশাপাশি চাল-ডালের ব্যবস্থা করতে হবে। নজর রাখতে হবে সঠিক লোকটি যেন তা পান।

তাহলে এই ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা দিতে সরকার কোথা থেকে বাড়তি অর্থ দেবে। অবশ্য এর উপায়ও বাতলে দিয়েছেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তাঁর মতে, এ বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে ‘শূন্য’ বরাদ্দ দিয়ে ওই টাকা সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় দেওয়া যেতে পারে। এই মুহূর্তে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে বাঁচানোই জরুরি।


উৎপাদন খাতের চিত্র
করোনার কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উৎপাদন খাত। বিদেশি ক্রয়াদেশ যেমন বাতিল ও স্থগিত করা হচ্ছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমছে। অবধারিতভাবেই কলকারখানায় উৎপাদন কমাতে হবে। তাহলে তো কলকারখানার শ্রমিকদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে। এবার দেখা যাক, কলকারখানায় কত লোক কাজ করেন। বিবিএসের উৎপাদন শিল্প জরিপ ২০১৯–এর প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, দেশে ৪৬ হাজার ২৯১টি কারখানা আছে। এসব কারখানায় ৫৮ লাখ ৭৯ হাজার ৮৪৪ জন কর্মী আছেন।

দেশে সবচেয়ে বেশি ২৩ হাজার ৫৫৭টি ছোট কারখানা আছে। এসব কারখানায় ১১ লাখ ২৭ হাজার ৮৪১ জন কর্মী আছেন। এ ছাড়া ১৬ হাজার ৬৮৯টি অতি ছোট কারখানায় কাজ করেন ২ লাখ ৬৩ হাজার ৭২০ জন। আর ৩ হাজার ৩১টি বৃহৎ কারখানায় কাজ করেন ৪০ লাখ ২৭ হাজার ১৪১ জন। এসব কারখানার বেশির ভাগই তৈরি পোশাক খাতের। এ ছাড়া মাঝারি আকৃতির কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ১৪টি। এসব কারখানায় ৪ লাখ ৬১ হাজার ১৪২ জন কাজ করেন।

করোনার ক্ষতি কাটাতে গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দিয়েছেন। এই তহবিলের অর্থ দিয়ে কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হবে। কিন্তু রিকশা-বাসচালক ও সহকারী, দোকানের সহকারী, হোটেল-রেস্তোরাঁর কর্মীদের মতো অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমজীবীদের জন্য কোনো টাকা বরাদ্দ নেই।

সামাজিক কর্মসূচির বরাদ্দ

বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে বরাদ্দ জিডিপির ১ শতাংশের মতো। অথচ সারা বিশ্বে জিডিপির অনুপাতে ১১ দশমিক ২ শতাংশ সামাজিক নিরাপত্তায় খরচ হয়।

আবার বাজেটের তুলনায় সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ কমছে। চলতি অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন কর্মসূচিতে ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৪ দশমিক ২১ শতাংশ। ১০ বছর আগেও এই হার ছিল সাড়ে ১৭ শতাংশের মতো। সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সরকার বিধবা ভাতা, দরিদ্র নারীদের মাতৃত্বকালীন ভাতা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি দিয়েছে। এ ছাড়া টেস্ট রিলিফ, ভালনারেবল গ্রুপ ফিড (ভিজিডি), কাজের বিনিময়ে টাকাসহ (কাবিটা) বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে। সব মিলিয়ে এই সামাজিক সুরক্ষায় ৭৪ লাখ লোক কোনো না কোনোভাবে সুবিধা পান।

সামগ্রিক বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকেরা। কৃষি, পরিবহন, হোটেল রেস্টুরেন্টসহ অনেক খাতের বহু শ্রমিক কাজ হারাতে পারেন। ওই সব খাতে নিয়োগ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। সরকার হয়তো এক-দুই মাস তাঁদের বসিয়ে খাওয়াতে পারবে, আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেওয়া সম্ভব হবে না। এর ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা বহু লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় শামসুল আলম একটি বিশেষ দুর্যোগকালীন তহবিল গঠনের সুপারিশ করেন। সেখানে দাতাদের কাছ থেকেও অর্থ নেওয়া যেতে পারে। রিকশাচালক, গাড়িচালক, পরিবহনশ্রমিকসহ দিন আনে দিন খায় মানুষের জন্য আপৎকালীন ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক মন্দা আসবে। এটি অর্থনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। সরকারি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান রাখতে হবে, বেসরকারি খাত সচল রাখতে হবে। বেসরকারি খাতকে এক বছরের জন্য সুদমুক্ত পরিচালনা মূলধন ঋণ দেওয়া যেতে পারে। এসব করলে শ্রমিকসহ কর্মজীবী মানুষের হাতে টাকা যাবে। বাজার থেকে পণ্য কিনে খেতে পারবেন তাঁরা।