শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ সবচেয়ে নিরাপদ

উন্নয়নের জাদুমন্ত্র নেই। একেক দেশে উন্নয়ন একেক কারণে হয়। তবে কখন কোনটা কীভাবে কাজে লেগে যায়, সেটা কেউ আগেভাগে বলতে পারে না। গত বছর অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি ও ফরাসি অর্থনীতিবিদ এস্থার দুফলো ‘দারিদ্র্য কীভাবে দূর করা’ যায় শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, এই অনিশ্চয়তার মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করা। এখন করোনার এই মহাদুর্যোগের সময় এই কথা আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।

অভিজিৎ ও এস্থার দুফলোর বক্তব্য হলো, একটি দেশের প্রবৃদ্ধি কখন কীভাবে বাড়তে শুরু করবে, তা বলা যায় না। কিন্তু প্রবৃদ্ধির এই বাড়বাড়ন্তের সময়ে যদি গরিব মানুষের স্বাস্থ্য যদি ভালো থাকে বা তাদের সাক্ষরজ্ঞান থাকে কিংবা পারিপার্শ্বিকতার বাইরে চিন্তা করার সক্ষমতা থাকে, তাহলে সেই উন্নয়নের ট্রেনে তারা সহজেই উঠে যেতে পারবে।
স্বাস্থ্যবান জনগণ ছাড়া উন্নয়নযজ্ঞ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আদর্শ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা পেলে একটি শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে শতভাগ উৎপাদনশীল হতে পারে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের দক্ষ মানবসম্পদ সূচকে বাংলাদেশের বিদ্যমান শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটি শিশু পূর্ণবয়স্ক হয়ে ৪৮ শতাংশ উৎপাদনশীল হতে পারবে।

স্বাধীনতার পর দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুসহ সামগ্রিকভাবে মৃত্যুহার কমেছে। চিকিৎসাসেবাও বিস্তৃত হয়েছে। আজ দেশের সব উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। ইউনিয়ন পর্যায়েও তা বিস্তৃত হয়েছে। অন্যদিকে গত ১০ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় তিনগুণ হয়েছে, এর কৃতিত্ব অবশ্যই বর্তমান সরকারের। কিন্তু স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে সরকারের বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে বাড়েনি।

দেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ এখনো সেই জিডিপির ২ শতাংশ এবং স্বাস্থ্যে ১ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ কারণে দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ সুস্থ ও সবলভাবে বেড়ে উঠতে পারছে না। ফলে তাদের কর্মকাল খুবই সংক্ষিপ্ত। দেশের তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়। একদিকে ভগ্ন স্বাস্থ্য, অন্যদিকে ব্যাপক খাটুনি ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব—এই দুয়ে মিলে এদের সিংহভাগ ৪০/৪৫ বছরের বেশি কাজ করতে পারেন না, যদিও দেশের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। অন্যান্য শ্রেণির নিম্ন আয়ের গতর খাটা মানুষের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। ফলে মধ্যবয়সের পর এঁদের বড় একটা অংশ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর যে বিকল্প নেই, এই মুহূর্তে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। সরকারও তা বিলম্বে হলেও বুঝতে পারছে। এখন তাই হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোও এগিয়ে আসছে। করোনার সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আগেই স্বাস্থ্য অবকাঠামো মজবুত করার বিকল্প নেই। আবার এই মহামারিই যে শেষ, তা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। ডেঙ্গু প্রতিবছরই হানা দিচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও মানুষের অভ্যাস বদলে যাওয়ার কারণেও কত অনাগত রোগ মানবজাতিকে আক্রমণ করার জন্য মুখিয়ে আছে, তা-ই বা কে জানে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বেশি, তারা সাধারণত দ্রুত এই করোনা সংক্রমণ থেকে সেরে উঠবে। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়াতে হলে পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। কিন্তু বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্যচাহিদা একভাবে পূরণ হলেও পুষ্টি চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। তাই আমাদের গড় আয়ু বাড়লেও ষাটোর্ধ্ব মানুষেরা নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে ভুগছেন। অথচ চীনের মতো দেশের ষাটোর্ধ্ব মানুষেরাও অনেক সক্ষম। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ডা. রুবায়ুল মোরশেদ বলেন, এটি হলো ‘মেডিকেল পভার্টি’, স্বাস্থ্যগত দারিদ্র্য। অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই স্বাস্থ্য বাবদ পকেট থেকে ব্যয় সবচেয়ে বেশি। মানে সরকারের ব্যয় সবচেয়ে কম। ফলে আমাদের দেশের মানুষের আয়ু বৃদ্ধি খুব সুখকর হয়নি। এর অর্থনৈতিক চাপ তো আছেই। অথচ স্বাস্থ্য ভালো থাকলে বয়স্ক মানুষেরাও কর্মক্ষম থাকতেন, ঘুরে বেড়াতে পারতেন, এতে সমাজের স্বাস্থ্যও ভালো থাকত।

আরেক নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস মনে করেন, সমৃদ্ধির সম্ভাব্য লক্ষণ হচ্ছে ভালো স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু। আয়ু বাড়লেও আমাদের স্বাস্থ্য ভালো হয়নি। দেশের প্রবৃদ্ধি বাড়ায় মানুষের সক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে। চিকিৎসাসেবার বিকাশ ও বিস্তার হয়েছে, তা ঠিক। মানুষের আয়ুও বেড়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা একভাবে বেসরকারি খাতে চলে যাওয়ায় মানুষের ব্যয় বাড়ছে। এতে বৈষম্যও বাড়ছে।

করোনা মহামারি দেশে অতটা ছড়িয়ে না পড়ুক, আমরা সবাই তা চাই। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ যেখানে এই করোনা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে আমাদের দেশের যদি রোগ ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এই স্বাস্থ্য অবকাঠামোতে কী ঘটবে, তা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। আবার রোগ যদি মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস করে, তাহলেও বিপদ। এই উভয় বিপদ থেকে রক্ষা পেতে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার অবকাশ তৈরি হয়েছে বলেই বোধ করি।