আগামী বাজেট নিয়ে চিন্তিত অর্থমন্ত্রী

সামনে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট। এই বাজেট তৈরিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের হাতে সময় আছে আর মাত্র দুই মাস। চিন্তিত অর্থমন্ত্রী। প্রতি বছর বাজেটের আকার বাড়ে ১২ থেকে ১৮ শতাংশ। আগামী বাজেটেও কি তাই বাড়বে? এখন যে চলছে বৈশ্বিক মহামারি-যার প্রভাবে বাংলাদেশসহ সবার অর্থনীতিই চুরমার হয়ে যাচ্ছে। তাহলে করণীয় কি? তা জানতেই অর্থমন্ত্রী বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির ও তার সচিবদের নিয়ে আজ মঙ্গলবার বৈঠকে বসেছিলেন।

রাজধানীর গুলশানে অর্থমন্ত্রীর নিজ বাসভবনে অনুষ্ঠিত 'করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বাংলাদেশে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব ও উত্তরণ' শীর্ষক পর্যালোচনা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আসাদুল ইসলাম, অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন।

বৈঠকের পর অর্থ মন্ত্রণালয় আজ রাতে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, অথর্মন্ত্রী সবার উদ্দেশে বলেছেন, চলতি অর্থবছরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি শংকিত। কালন, চলছে বৈশ্বিক মহামারি করোনা। এদিকে আসছে আগামী অর্থবছরের বাজেট। করোনার প্রভাবে আগামী বাজেটে যাতে আর্থিক সংকট না হয়, সেজন্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা চাওয়া হবে বলে সচিবদের আশ্বস্ত করেছেন তিনি। এ জন্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলেও তাদের জানান।

করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কী কী প্রভাব পড়তে পারে-তার একটি ফিরিস্তিও সচিবদের সামনে তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব কতদিন প্রলম্বিত হয় আমরা জানি না। এরই মধ্যে আমাদের আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় কম হয়েছে।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অর্থবছর শেষে এর পরিমাণ আরও কম হতে পারে। ফলে অন্যান্য দেশের মত নানামুখী অর্থনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা করতে হতে পারে বাংলাদেশকেও।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে দীর্ঘ ছুটি বা কার্যত লক-ডাউনের (অবরুদ্ধ অবস্থা) ফলে রপ্তানিমুখী শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কুটিরশিল্পসহ উৎপাদনমুখী সব প্রতিষ্ঠানেই বিরূপ প্রভাব পড়েছে। পরিবহন সেবা ব্যাহত। স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমবে এবং সরবরাহ ববস্থায় সমস্যা হবে।

অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, চলমান মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা দেরি হওয়ার কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। হোটেল-রেস্তোরা, পরিবহন এবং আকাশপথে যোগাযোগের খাতও বিপদে পড়েছে। এ খাতগুলোর ওপর ইতিমধ্যেই বিরূপ প্রভাব পড়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বিরূপ প্রভাব পড়েছে দেশের শেয়ারবাজারেও। এদিকে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের চাহিদা কমেছে। এর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে প্রবাসী আয়ের (রেমিটেন্স) ওপরও।

তবে অর্থমন্ত্রী প্রবাসী আয় নিয়ে অতটা হতাশ নন বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। যুক্তি হিসেবে অর্থমন্ত্রী বলেন, যেহেতু গত আট মাসে প্রবাস আয়ে ২১ শতাংশের মত প্রবৃদ্ধি ছিল, সেহেতু আগামী চারমাসে তা কিছুটা কম হলেও অর্থবছর শেষে আগের অর্থ বছরের তুলনায় কম হবে না বলে আশা করা যায়।

বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে এবং ইতিমধ্যেই নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গত অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে ৮ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে এগোলেও প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস জনস্বাস্থ্যসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির উপর নেতিবাচক থাবা বসাতে যাচ্ছে। সবাই জানেন, বাংলাদেশও এই নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্ত নয়-এসব কথাও বলেন অর্থমন্ত্রী।

এখন পর্যন্ত কী করা হয়েছে

মুস্তফা কামাল বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা। পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় আহারের ব্যবস্থা করা। সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কী করা হয়েছে, তার একটি চিত্রও তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। বলেন, দেরি না করেই স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় এরই মধ্যে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন, সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি ও মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়েছে। অর্থ বিভাগের অপ্রত্যাশিত ব্যয় ব্যবস্থাপনা খাত থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবসায়-বান্ধব কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন-আগামী জুন মাস পর্যন্ত কোন গ্রাহক যদি কিস্তি পরিশোধে অপরাগও হন, তারপরও তাকে ঋণ খেলাপি না করার ঘোষণা দিয়েছে। এনজিওগুলোর গ্রাহকদের ক্ষেত্রেও জুন পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধে অপরাগ হলে ঋণ খেলাপি করা হবেনা।

রপ্তানি আয় আদায়ের সময়সীমা ২ মাস থেকে বৃদ্ধি করে ৬ মাস করা হয়েছে। একইভাবে আমদানি ব্যয় মেটানোর সময়সীমা ৪ মাস থেকে বৃদ্ধি করে ৬ মাস করা হয়েছে। মোবাইলে ব্যাংকিংয়ে আর্থিক লেনদেনের সীমা বাড়ানো হয়েছে।

শিল্প উৎপাদন এবং রপ্তানি বাণিজ্যের আঘাত মোকাবিলায় কিছু আপৎকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে এবং রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য এরই মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রণোদনা প্যাকেজের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।

 আরও কী করা হবে

অর্থমন্ত্রী বলেন, রপ্তানীমুখী শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং কুটিরশিল্পবিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় আরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হাতে নেওয়া হবে। অব্যাহত থাকবে বিনামূল্যে ভিজিডি, ভিজিএফ এবং ১০ টাকা কেজি দরে চাল সরবরাহ কর্মসূচি। ‘ঘরে-ফেরা’কর্মসূচির আওতায় নিম্নআয়ের ব্যক্তিদের নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যেতে সহায়তা দেওয়া হবে। গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য দেওয়া হবে বিনামূল্যে ঘর ৬ মাসের খাদ্য এবং নগদ অর্থ।

জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আজ রাতে মোবাইল ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‌‘করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলায় আমরা প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নেবা। এখন দরকার সবারই ঘরে থাকা। এ যুদ্ধ আমরা মোকাবিলা করবই।’

আগামী বাজেট নিয়ে জানতে চাইলে মুস্তফা কামাল বলেন, ‌‘বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকসহ (আইডিবি) সব উন্নয়ন সহযোগীর কাছেই আমরা অর্থ সহায়তা চাইব।’