করোনা-উত্তর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৩ শতাংশ, ইকোনমিস্টের পূর্বাভাস

দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব কটি দেশেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সন্ধান পাওয়া গেছে। ঘনবসতি, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অসচেতনতা, ভারসাম্যহীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এই অঞ্চলকে করোনাভাইরাস মহামারির সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের ঝুঁকিতে ফেলেছে। প্রাদুর্ভাবের বিস্তার রোধে প্রতিরোধমূলক যেসব ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার অর্থনৈতিক ক্ষতি ব্যাপক হবে বলে মনে করছে লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। তারা আশা করছে, প্রতিটি দেশই রাজস্ব ও আর্থিক প্রণোদনার পদক্ষেপ নেবে। তবে দেশভেদে এই পদক্ষেপের পরিধি আলাদা হবে।

দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট মনে করছে, এ জটিল অবস্থায় চলতি বছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৩ শতাংশ, যা আগে সাড়ে ৭ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছিল।

এক বিশ্লেষণে দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, বাংলাদেশ ও ভারত তাদের শক্তিশালী অথনৈতিক অবস্থানের কারণে তুলনামূলক বেশি প্রণোদনা সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। অন্যদিকে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় প্রণোদনার ধরন কিছুটা সীমিত হবে।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কর্মকৌশল ঠিক করতে সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত ৮টি দেশের নেতারা ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দেন। এ অঞ্চলে খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাসটি। গত কয়েক দিনে দক্ষিণ এশিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানে এ হার অনেক বেশি। এই সংখ্যা যা প্রকাশ করা হয়েছে তার চেয়েও অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, কারণ পরীক্ষার অভাবে সঠিক সংখ্যাটি বের হয়নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গত ২০ মার্চ পর্যন্ত প্রতি ১০ লাখে ১০টি পরীক্ষা করেছে ভারত। একই সময়ে যেখানে ভিয়েতনাম প্রতি ১০ লাখে ১৬০ জনের করোনা পরীক্ষা করেছে। তবে করোনা মোকাবিলায় প্রকৃতিগতভাবেই দক্ষিণ এশিয়া কিছু সুযোগ পেয়েছিল। একটি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তরুণ জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলে। এটি পরীক্ষিত যে তরুণদের ওপর এই ভাইরাসের ক্ষতিকারক প্রভাব তুলনামূলক কম। দ্বিতীয়টি হলো এ অঞ্চলের গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া, যা এই ভাইরাসের বিস্তারকে বাধা দেয়।

তবে এই সুবিধার খুব বেশি সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না এ অঞ্চলের মানুষের জন্য। করোনাভাইস মোকাবিলায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব কটি দেশই ঘন জনবসতিপূর্ণ। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বাস্তবায়ন করতে হিমশিম খাচ্ছে দেশগুলো। লকডাউন, কারফিউসহ নানা পদক্ষেপেও নিশ্চিত হচ্ছে না সামাজিক দূরত্ব। এর মধ্যে জনগণের স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতনতার অভাব, নিরাপদ পানির অসম বণ্টন এই ভাইরাস মোকাবিলার পথকে কঠিন করে দিচ্ছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এই অঞ্চলে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যে হু হু করে বাড়বে, এমন আশঙ্কা করতেই হচ্ছে। স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোয় অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, চিকিৎসকের সংখ্যা কম ও হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় একদমই কম শয্যা থাকায় এটা বলাই যায় ভাইরাসের বিস্তার বাড়তে থাকলে, সেই বিপুল পরিমাণ মানুষকে চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা হবে না এ অঞ্চলের।

দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ভারতে প্রতি ১ হাজার জনের জন্য চিকিৎসক ছিল শূন্য দশমিক ৮ জন। অর্থাৎ, একজনেরও কম। পাকিস্তানে তা শূন্য দশমিক ৯ জন, শ্রীলঙ্কায় ১ দশমিক ১ জন। অন্যদিকে শিল্পোন্নত দেশের জোট জি–৭–ভুক্ত দেশগুলোতে যা ৩ জন। হাসপাতালে ১ হাজার মানুষের জন্য শয্যা রয়েছে ভারতে শূন্য দশমিক ৫টি, পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৬টি, শ্রীলঙ্কায় ৩ দশমিক ৬টি এবং জি–৭–ভুক্ত দেশে ৩ দশমিক ৬টি। ভারতে একজন মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা হয় ৮৩ ডলার। পাকিস্তানে ৩৩ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১৬১ ডলার। অন্যদিকে জি–৭–ভুক্ত দেশে তা ৭ হাজার ২৩০ ডলার। তাই এ পরিস্তিতি নিয়ে এমন একটি প্রাদুর্ভাবের বিষয়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানো এ অঞ্চলের জন্য কঠিন।

দক্ষিণ এশিয়ায় বিপুল পরিমাণ মানুষ কম মজুরি এবং পরিবারের একটি বড় অংশ তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য কর্মসংস্থানের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে এ অঞ্চলের কিছু দেশের সরকার যেমন পাকিস্তান সরকার লকডাউন করতে চায়নি। পরে পরিস্থিতির কারণে ভারত ও শ্রীলঙ্কা দেশজুড়ে লকডাউন করেছে। পাকিস্তানের প্রায় সব অঞ্চল অপ্রয়োজনীয় কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ গত ২৬ মার্চ থেকে আংশিক লকডাউন জারি করেছে। এ ছাড়া ইরানের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তের কারণে আফগানিস্তানে এখনো সব খোলাই রয়েছে।

বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে
দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আশঙ্কা করছে, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে এ অঞ্চলে চলতি বছর প্রবৃদ্ধি অনেকই কমবে। জনগণের চলাচল কমাতে সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কারণে ভোক্তা চাহিদা কমে যাওয়ায় একটা বড় ধাক্কা লেগেছে চাহিদার দিক দিয়ে—এতে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেরই প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। এরপর কারখানা ও ব্যবসা–বাণিজ্য বন্ধ হওয়ায় সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর গিয়ে পড়েছে আরেকটি ধাক্কা। পরে যা চাহিদার ওপর আরেক ধরনের ধাক্কা দেবে। বিশ্বজুড়ে একই পদক্ষেপ নেওয়ায় তা রপ্তানি চাহিদাও সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে। ভুটান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো ভ্রমণে সীমাবদ্ধতা আনার জন্য ও চাহিদা কমে যাওয়ায় পর্যটক আগমন বন্ধ করে দিয়েছে। ভোক্তার পক্ষ থেকে চাহিদা কমে যাওয়া, সেই সঙ্গে রপ্তানি কমে যাওয়ায় নিয়মিত ব্যবসায়িক আয় কমবে। ফলে কোম্পানিগুলো তাদের নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না এবং বিনিয়োগের যে পরিকল্পনা ছিল, তা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ও সরকারপ্রধানেরা মহামারির অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটাতে বিভিন্ন পুনরুদ্ধার প্যাকেজ ঘোষণা করছে। তবে এসব পদক্ষেপে অর্থনৈতিক ক্ষতি খুব বেশি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে, তা বিশ্বাস করা কঠিন। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদের সুদহার কমিয়েছে এবং আর্থিক খাতে তারল্য নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে।

বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান সরকার প্রাথমিকভাবে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে সহায়তা করার জন্য আর্থিক পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। আর্থিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে জন্য ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে ভারত সরকার, যা দেশটির মোট জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। পাকিস্তান ঘোষণা করেছে ৭১০ কোটি ডলারের পুনরুদ্ধার প্যাকেজ, যা দেশটির মোট জিডিপির ২ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ সরকার ৬০ কোটি ডলারের আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা মোট জিডিপির শূন্য দশমিক ২ শতাংশ।

পুনরুদ্ধার পদক্ষেপ প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারবে না
সংকট আরও বাড়লে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর সরকারকে হয়তো আর্থিক প্যাকেজের আকার বাড়াতে হবে। রাজস্ববিষয়ক প্রণোদনাগুলো সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষভাবে নগদ স্থানান্তর ও কর মওকুফ—এমন পদক্ষেপ হয়ে থাকে। অন্যদিকে আর্থিক প্রণোদনা সাধারণত ঋণ পরিশোধ স্থগিত করা এবং বাজারে পর্যাপ্ত তারল্য সরবরাহ নিশ্চিত করার দিকে নজর দেয়। যা–ই হোক, কোন দেশ কতটুকু প্রণোদনা বাড়াতে পারবে, তা দেশগুলোর ওপর নির্ভর করবে।

বাংলাদেশ, ভারত এখনো বড় আকারের প্যাকেজ সরবরাহ করেনি। যদিও আশা করা যায় যে তারা পর্যাপ্ত আর্থিক নীতিমালা স্থাপন করে ও সরকারি ঋণ এবং রাজস্ব ঘাটতির স্তর ঠিক রেখে আগ্রাসী আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করতে পারবে। অন্যদিকে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার জন্য আইএমএফ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা শিথিল করলে এই দুটি দেশের পক্ষে আর্থিক প্রণোদনা বাড়ানো সম্ভব হবে। যদিও শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের মতো ঋণগ্রহীতা ও রাজস্ব ঘাটতির দেশে তা সব সময়ই বেশ সীমাবদ্ধ। এসব দেশের মুদ্রানীতিবিষয়ক প্রণোদনা দেওয়ার সক্ষমতাও সীমাবদ্ধ কারণ কর্তৃপক্ষ সব সময়ই চায় তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে।

দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট মনে করছে, এ জটিল অবস্থায় চলতি বছর ভারতের প্রবৃদ্ধি হবে ২ শতাংশ, যা আগে ৬ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি থমকে যাবে। কোনো প্রবৃদ্ধিই হবে না দেশটিতে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৩ শতাংশ, যা আগে সাড়ে ৭ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছিল। শ্রীলঙ্কার প্রবৃদ্ধি পূর্বাভাস ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করছে দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট।