মন্দা এসে গেছে, প্রস্তুতি নিচ্ছেন তো?

>করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে এনেছে। মন্দার সময় মানুষ চাকরি হারায়, আয় কমে যায়। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছিল, তাতে বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়েছিল। মন্দার সময় পরিবারকে আর্থিকভাবে সুরক্ষায় রাখতে কিছু পরামর্শ।

মন্দা এসেই গেল। না, কোনো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বা স্বাগত জানাতে কোনো সমাবেশ নয়, অর্থনৈতিক মন্দার যাত্রা শুরু হয়েছে বিশ্বব্যাপী উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ, হোটেল পর্যটকশূন্য হয়ে যাওয়া, বিপণিবিতান ক্রেতাহীন হয়ে যাওয়া এবং কারখানা বন্ধের মধ্য দিয়ে। সব মিলিয়ে চাহিদায় ধস। আক্রান্ত মোটামুটি সব দেশ।

বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ক্রয়াদেশ বাতিলের মুখে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত নিত্যপণ্য ও ওষুধ ছাড়া অন্যান্য পণ্যের তেমন কোনো ক্রেতা থাকবে না। ১০ এপ্রিল সবকিছু খুলবে কি না, সেটাও এখনই হলফ করে বলা যাচ্ছে না।

সব মিলিয়ে ব্যবসা বড় ধরনের সংকটে পড়ে গেছে। এতে বিপাকে বেসরকারি খাতের শ্রমিক–চাকরিজীবী, ছোট ব্যবসায়ী, হকার, রিকশা–অটোরিকশাচালক ও শ্রমজীবী মানুষেরা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু এখন ভালো আয় করতে পারবে না, সেহেতু বেতন বিলম্বে হতে পারে। কেউ কেউ বিনা বেতনে বাধ্যতামূলক ছুটির মুখেও পড়তে পারেন। কেউ কেউ চাকরি হারাতে পারেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে যেতে পারে।

২০০৭ ও ২০০৮ সালে বিশ্বজুড়ে যে অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছিল, তাতে বহু প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়েছিল। বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী মন্দা হয়েছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত, যাকে মহামন্দা বলে। আরেকটি মন্দার সময় ঘনিয়ে এসেছিল। তাতে ঘি ঢালছিল মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ। এবার করোনাভাইরাস এসে আগুন জ্বালিয়ে দিল। আগামী কয়েক মাসে করোনাভাইরাস হয়তো নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে, কিছু অর্থনৈতিক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী, যা দেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও একই কথা বলছে। যেমন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাবে করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে আড়াই কোটি মানুষ কাজ হারাতে পারেন।

এ ধরনের মন্দার সময় নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকার হয়তো নানা সহায়তা দেয়। কিন্তু এত দিন যাঁরা মোটামুটি ভালো একটি চাকরি বা ব্যবসা করে স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করেছেন, সেই চাকরিজীবী ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষকে বিপাকে পড়তে হতে পারে। যাঁরা বেসরকারি খাতে কাজ করেন, তাঁদের ঝুঁকি বেশি। তাই এখনই নিজের পরিবারের আর্থিক সুরক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নিয়ে রাখতে হবে।

সবার আগে নিজের ক্রেডিট কার্ডে ঋণ থাকলে সেটা পরিশোধ করে দিন। বাংলাদেশে ক্রেডিট কার্ডের সুদহার অনেক বেশি। পরে সময়মতো পরিশোধ না করতে পারলে বড় অঙ্কের মাশুল গুনতে হবে। যদিও কোনো কোনো ব্যাংক এখন ছাড় দিচ্ছে। এরপর পুরো লেখাটি পড়ুন। এবার আসুন, মন্দা কী, সেটার আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা জেনে নিই। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ বলছে, মন্দা হলো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়া এবং সেটা কয়েক মাস স্থায়ী হওয়া। মূল বিষয় হলো, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমে যাবে, শিল্পের উৎপাদন কমবে, পণ্য বিক্রি কমবে। মানুষের জীবনের ওপর প্রভাব হলো, আয় কমে যাবে।

মন্দা (রিসেশন) যখন দীর্ঘায়িত হয়, তখন সেটা পরিণত হয় মহামন্দায় (ডিপ্রেশন)। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, মন্দা একটা নির্দিষ্ট সময় পর ঘুরেফিরে আসে। আবার যুদ্ধ, বাজে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা, রোগ ইত্যাদির কারণে মন্দা হতে পারে।

বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস গত অক্টোবর মাসে একটি লেখা প্রকাশ করেছে, যেখানে মন্দা থেকে নিজেকে রক্ষায় কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়।

যার প্রথমটি হলো জরুরি তহবিল তৈরি। দায়িত্বশীল মানুষেরা মোটামুটি ছয় মাসের জন্য নিজের পরিবার চালানোর অর্থ নিজের কাছে রাখেন। আপনি ছয় মাস না পারলেও তিন মাসের সমপরিমাণ অর্থ অন্তত রাখুন। ফোর্বস বলছে, এখন যে কাজটি আপনি সবচেয়ে জরুরি ভিত্তিতে করতে পারেন, সেটি হলো তহবিল গঠন এখনই শুরু করা। মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের অংশ হিসেবে যে ব্যাংকে আপনার বেতন হয়, সেখানে গিয়ে সঞ্চয়ী হিসাব (ডিপিএস) খুলতে পারেন। বেতন হলেই ব্যাংক জমা খাতে টাকা কেটে রাখবে। যেহেতু হাতে আসবে না, সেহেতু খরচের সুযোগ নেই। 

এমন যদি হয়, আপনার বেতন বা আয় ততটা বেশি নয় যে কয়েক মাসের মধ্যে বেশ ভালো পরিমাণে অর্থ জমিয়ে ফেলতে পারবেন, তাহলে আপনার জন্য ফোর্বস–এর দ্বিতীয় পরামর্শ। এটি হলো খরচ কমিয়ে ফেলা। বেতনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ অর্থের সমপরিমাণ খরচ কমিয়ে ফেলা তেমন কঠিন কাজ নয়। এ জন্য আপনার খরচের একটি তালিকা করে ফেলুন। সেখান থেকে কোন কোন খরচ কমানো যায়, সেটি খুঁজে বের করুন। বাসা ভাড়া ও নানা সেবার বিল বাবদ স্থায়ী খরচ কত, বাজার খরচ কত, ছেলেমেয়ের শিক্ষার খরচ কত, নিজের খরচ কত—এসবের পূর্ণাঙ্গ তালিকা থাকলে আপনি কোথায় কোথায় খরচ কমাতে পারবেন, তা ঠিক বের করে ফেলতে পারবেন। আপনার যদি ভালো অঙ্কের একটি জরুরি তহবিল থাকে, তাহলে খরচ বেশি কমানোর দরকার নেই। যদি তহবিল হয় ভাড়ে মা ভবানী, তাহলে নির্দয়ভাবে খরচ কমানো ছাড়া আপনার কীই–বা করার আছে।

ফোর্বস–এর পরের পরামর্শটি হলো, আপনি যে চাকরি বা ব্যবসা করেন, সেটি যদি হারানোর ঝুঁকি থাকে, তাহলে ভিন্ন পথ এখনই দেখুন। মন্দা এসে গেলে প্রতিষ্ঠান বন্ধের সহজ শিকার হওয়ার দরকার নেই। ফোর্বস–এর লেখায় পরামর্শগুলো দিয়েছেন আর্থিক পরামর্শক লিজা ফ্রেজিয়ার। মনে রাখবেন, কোম্পানি যখন দেউলিয়া হয়, তখন আর্থিক পরামর্শকেরও চাকরি থাকে না। আবার বাংলাদেশের পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ধসের সময় কত টাকা খুইয়েছেন, কান পাতলে সেটাও শোনা যায়। তাই নিজের বিবেচনা ও অভিজ্ঞতায় নিজের প্রস্তুতি ও সিদ্ধান্তই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

২০১৮ সালের নভেম্বরে ফোর্বস–এই মন্দার সময় ব্যক্তিগত বিনিয়োগ নিয়ে আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, শিরোনাম ছিল ‘নেক্সট রিসেশন ইজ কামিং, হেয়ার ইজ হাউ টু প্রটেক্ট ইউর পোর্টফোলিও​’। এতে লেখক জন ই গিরোয়ার্দ বলেন, আগে হিসাব করুন কয়েক বছর চলতে আপনার কত টাকা লাগতে পারে। সেই টাকায় বন্ডের মতো বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিমে রাখুন (বাংলাদেশে হতে পারে সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকে রাখা)। গিরোয়ার্দের মতে, নিরাপদে রাখা টাকার বাইরে বাকি অর্থ নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করুন। পাঁচ বছরের জন্য করলে দেখবেন মুনাফা ভালো আসছে।

ব্যক্তিগতভাবে আমার ভালো লেগেছে যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম সিএনবিসির ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাডভাইজার কাউন্সিলের সদস্য বোনপার্থের একটি পরামর্শ। গত আগস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তিনি মন্তব্য করেন, শেয়ারবাজারের উত্তাপ-শীতলতা পরিবার থেকে দূরে রাখুন। পুঁজিবাজারে ধসের কারণে সারা দিন মুখ গোমড়া করে বসে থাকবেন। স্বামী–স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করবেন, এটা হতে পারে না। কারণ, আপনার রোজগার তো পরিবারের জন্যই।

এবার আসি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে খরচ কমানো যায় কীভাবে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে আমার দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সংসারে যিনি রোজগার করেন, তিনিই নিজের স্বাচ্ছন্দ্য কমিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় কমিয়ে ফেলেন। যেমন পরিচিত এক ব্যক্তি অফিসে যাওয়ার পথে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া শুরু করেছেন। এতে তাঁর ব্যয় কমবে ১ হাজার ৪০ টাকা। একজন তিন কক্ষের বাসা ছেড়ে দুই কক্ষের বাসা নিয়ে মাসে পাঁচ হাজার টাকা বাঁচিয়েছেন। এসব অবশ্য মন্দার কারণে নয়, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে। মন্দাকালে কৌশলগুলো খারাপ হবে না। 

এ সময়ে কোনোভাবেই বাজে খরচ করবেন না। পুরোনো হয়ে গেলেও রেফ্রিজারেটরটি আরও কিছুদিন ব্যবহার করুন। নতুন মডেলের মুঠোফোনের দিকে নজর দেবেন না। জুতা-জামা না কিনলে ভালো। খরচ বাঁচাতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) চালানো বন্ধ রাখতে পারেন, কফি খাওয়া বাদ দিতে পারেন, বাইরে খাওয়া বাদ দিতে পারেন। বাজার খরচ কমিয়ে ফেলাটা সহজ নয়। তবু চেষ্টা করতেই হবে।

আপনার চাকরি-রোজগারের বিষয়ে স্ত্রী–স্বামী, সন্তানদের জানান। তাদেরও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে উৎসাহিত করুন। পরিবার যদি পাশে থাকে, কোনো সংকটই আসলে সংকট নয়।