পোশাক কারখানা বন্ধ করতে চাননি কেউই

শনিবার সকাল থেকে রাজধানী অভিমুখে ছিল শ্রমজীবী মানুষের ঢল। তাঁদের অধিকাংশ ছিল পোশাক কারখানার শ্রমিক। রোববার কারখানা খুলবে, তাই যে যেভাবে পেরেছে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছে। ছবি: প্রথম আলো
শনিবার সকাল থেকে রাজধানী অভিমুখে ছিল শ্রমজীবী মানুষের ঢল। তাঁদের অধিকাংশ ছিল পোশাক কারখানার শ্রমিক। রোববার কারখানা খুলবে, তাই যে যেভাবে পেরেছে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছে। ছবি: প্রথম আলো

করোনার ঝুঁকির মধ্যেও পোশাক কারখানা বন্ধ করতে চাননি শিল্পমালিকেরা। তাতে সায় ছিল সরকারেরও। মূলত মালিকদের পাশাপাশি সরকারের শ্রম এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্তহীনতা ও সমন্বয়হীনতার কারণেই ভয়াবহ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব না মেনে ঝুঁকি নিয়ে হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকা ও আশপাশের শিল্পাঞ্চলে ফিরেছেন। এমনকি হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠনের নেতারা করোনার এই দুর্যোগে কারখানা বন্ধ রাখার বিষয়ে জোরালো দাবিই করেননি।

শনিবার সকাল থেকে রাজধানী অভিমুখে ছিল শ্রমজীবী মানুষের ঢল। তাঁদের অধিকাংশ ছিল পোশাক কারখানার শ্রমিক। রোববার কারখানা খুলবে, তাই যে যেভাবে পেরেছে গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেছে। গণমাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের কর্মস্থলে ফেরার চিত্র দেখে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সারা দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলে দেওয়ার জন্য পোশাকশিল্প মালিকদের কঠোর সমালোচনা করেন অনেকেই। দিনভর এই আলোচনা-সমালোচনার পর তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ রাত পৌনে ১০টায় কারখানা বন্ধ রাখতে সদস্যদের প্রতি অনুরোধ করে। বিকেএমইএ কারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত দেয় রাত ১২টায়। এরপর গতকাল রোববার ঢাকায় প্রবেশ ও ঢাকা থেকে বের হওয়ার সব পথ বন্ধ করে দেয় পুলিশ।

গত ১৫ দিনে যা ঘটেছে

অনেকেই প্রশ্ন করেছেন কেন এ রকম হলো। জানা গেছে, গত ২১ মার্চ শ্রম ভবনে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের সভাপতিত্বে সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষের ত্রিপক্ষীয় সভা হয়। তাতে বিজিএমইএর বর্তমানে ও সাবেক দুই সভাপতি, বিকেএমইএর সভাপতি ও একজন সহসভাপতি, জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতিসহ শ্রম মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন। সভায় অধিকাংশ পোশাকশিল্প মালিক প্রতিনিধি ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি কারখানা খোলা রাখার বিষয়ে তাঁদের মতামত দেন। তবে কারখানা খোলা বা বন্ধের বিষয়ে কথা বলার চেয়ে সভায় সংকট মোকাবিলায় মালিকেরা সরকারের কাছে আর্থিক অনুদান, প্রণোদনার অর্থ ছাড় করার বিষয়ে বেশি উচ্চকিত ছিলেন। সভা শেষে বিকেএমইএর একজন নেতা বলেন, শ্রমিকেরা যে পরিবেশে বসবাস করেন, তার চেয়ে কারখানা পরিবেশ অনেক ভালো। তা ছাড়া করোনা প্রতিরোধে প্রতিটি কারখানায় হাত ধোয়াসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন।

পরদিন শ্রম ভবনে ২১টি শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী। সেখানে ৯টি শ্রমিক সংগঠনের নেতারা করোনা প্রতিরোধে কারখানা বন্ধের দাবি জানান। তবে এর বিরোধিতা করে ১১টি সংগঠন। তখন শ্রম প্রতিমন্ত্রী জানিয়ে দেন, আপাতত কারখানা চলবে। আর কারখানা বন্ধের বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।

বৈঠকের দুই দিন পর কয়েকজন প্রভাবশালী পোশাকশিল্প মালিক জানান, তাঁরা কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত দেবেন না। তাঁরা চাইছেন সরকারের ওপর মহল থেকে ঘোষণা আসুক। তাতে মালিকদের দাবিদাওয়া আদায়ে কিছুটা সুবিধা হবে, এমন ইঙ্গিত দেন দু-একজন মালিক। সে কারণে ২৩ মার্চ সরকারের তরফ থেকে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা দিলেও মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ চুপ ছিল। সেদিন অবশ্য সংগঠন দুটির নেতারা বলেন, ভাষণে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দেবেন, সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পোশাকসহ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মজুরি দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। মালিকদের দুই সংগঠনই তাৎক্ষণিকভাবে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়।

সরকারের দেওয়া ছুটি শুরু হলে বিজিএমইএ ২৬ মার্চ কারখানা বন্ধ রাখতে সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানায়। পরদিন বিকেএমইএ একই রকম নির্দেশনা দেয়। তবে বিজিএমইএর সিদ্ধান্তে প্রভাবশালী কয়েকজন পোশাকশিল্প মালিক ক্ষুব্ধ হোন। তাঁরা সরকারের ওপর মহলকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কারখানা বন্ধ রাখলে পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অবশ্য ২৬ মার্চ পর্যন্ত ৯৫৯ কারখানার ২৬৭ কোটি ডলারের পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ার তথ্য জানানো হয়য়।

গত ২৮ মার্চ শ্রম মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, যেসব কারখানায় ক্রয়াদেশ আছে ও করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সামগ্রী পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস, স্যানিটাইজার, ওষুধ ইত্যাদি উৎপাদন করছে, সেসব কলকারখানা বন্ধে সরকার কোনো নির্দেশনা দেয়নি। এই বিজ্ঞপ্তির পরপরই বিজিএমইএ নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসে। তারা ডিআইএফইর নির্দেশনা মানতে সংগঠনের সদস্য পোশাক কারখানা মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানায়।

কারখানা খোলা আর বন্ধ রাখার বিতর্কের মধ্যেই ১ এপ্রিল দেশের বাণিজ্য পরিস্থিতি নিয়ে সভা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সেখানে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতারাও ছিলেন। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজেও একসময় বিজিএমইএর সভাপতি ছিলেন। সভা শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পোশাক কারখানা চলতে বাধা নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। সভায় ৫ এপ্রিল কারখানা খোলার বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেদিনই আবার ডিআইএফই আরেকটি বিজ্ঞপ্তি দেয়। তাতে অবশ্য আগের নির্দেশনাগুলো পুনরায় তুলে ধরে সরকারের এই প্রতিষ্ঠান। এই নির্দেশনার পরদিন বিকেএমইএ ৪ এপ্রিলের পর সদস্য পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার বিধিনিষেধ তুলে নেয়। কারখানা খোলার বিষয়ে মালিকদের ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরামর্শ দেন সংগঠনের সভাপতি। তবে বিজিএমইএ নতুন করে কিছু বলেনি। শনিবার রাত পর্যন্ত চুপ থাকে সংগঠনটি। তবে এর আগেই আশুলিয়া অঞ্চলের মালিকেরা নিজেরা রোববার থেকে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেন এবং তা বিজিএমইএকে জানিয়ে দেন।

পরিস্থিতি নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে গত শনিবার গভীর রাতে নিজেদের ফেসবুক পেজে বিজিএমইএ বলে দেয় যে কারখানা বন্ধ করার অধিকার সংগঠনটির নেই। সেটি করতে পারে একমাত্র ডিআইএফই। অথচ বিজিএমইএ তার সদস্যদের স্বার্থে পোশাক কারখানা বন্ধ রেখেছে, সেই নজির আছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আশুলিয়ায় শ্রমিক আন্দোলন হলে ৫৯টি কারখানা চার দিন বন্ধ রেখেছিল বিজিএমইএ।

আবার শুরু থেকেই শক্ত কোনো অবস্থান নেয়নি শ্রম ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মূলত কারখানা বন্ধের দায় কেউ নিতে চায়নি বলেই এই বিপত্তি।