মৌসুম হারাচ্ছেন মোটরসাইকেল বিক্রেতারা

শীত শেষে গ্রামে যখন রবিশস্য ওঠা শুরু করে, তখন মোটরসাইকেলের বিক্রি বাড়ে। তারপর পয়লা বৈশাখ ও পবিত্র ঈদুল ফিতর মিলিয়ে প্রতি বছর মার্চ থেকে শুরু করে জুন পর্যন্ত ভরা মৌসুম কাটান বিক্রেতারা। এ বছর মার্চ মাসে মোটামুটি ১৫ দিন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছে। চলতি এপ্রিলে আবার কবে বেচাকেনা শুরু হবে, তার ঠিক নেই।

সব মিলিয়ে অন্তত এক মাস দেশে মোটরসাইকেল বিক্রি শূন্যের কোটায় থাকবে। এ গেল করোনার সরাসরি আঘাত। পরোক্ষ নেতিবাচক প্রভাবের কথাও বলছেন মোটরসাইকেল বিপণনকারীরা। তাঁদের দাবি, করোনার কারণে অর্থনীতির গতি কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষের আয় কমে যায়। মানুষ ব্যয় কমিয়ে দেয়। মন্দার সময় দামি ও বিলাসজাত পণ্য কেনা আগে বাদ দেয় মানুষ। এ তালিকায় মোটরসাইকেলও রয়েছে।

উদ্যোক্তারা বছর শেষে মোটরসাইকেল বিক্রিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন, যা ২০১৫ সালের পর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল।
বাংলাদেশ মোটরসাইকেল অ্যাসেম্বলার্স ও ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএএমএ) সভাপতি ও বাজাজ ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বাজারজাতকারী উত্তরা মোটরসের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সবাই এ বছর একটা ভালো লেনদেনের আশা করেছিল। তা আর হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘এক মাসে ৫০ থেকে ৬০ হাজার ইউনিট মোটরসাইকেল বিক্রি হয়। সেটা আমরা হারালাম।’

একটি কোম্পানির বাজার জরিপ অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৯ সালে দেশে মোটরসাইকেল বিক্রি হয়েছিল প্রায় ৫ লাখ ৪৯ হাজার, যা আগের বছরের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেশি। ৪ বছরের মধ্যে গত বছরই বিক্রির প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে কম ছিল। চার বছর মিলিয়ে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩০ শতাংশ।

২০১৯ সালে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকর করে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ও চালকের লাইসেন্সের ওপর কড়াকড়ি আনা এবং কৃষি খাতের প্রধান ফসলগুলোতে ভালো দাম না পাওয়াকে বিক্রি কমে যাওয়ার বড় দুটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন উদ্যোক্তারা।

বিক্রেতারা বলছেন, ১৫ মার্চের পর থেকে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। দেশজুড়ে লকডাউন আসার আশঙ্কাটিও ছিল। আর ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে দোকানপাট তো বন্ধই।

জানতে চাইলে জাপানের ইয়ামাহা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেলের পরিবেশক এসিআই মোটরসের নির্বাহী পরিচালক সুব্রত রঞ্জন দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘পয়লা বৈশাখের আগে প্রচুর মানুষ মোটরসাইকেল কেনেন। সেটা আমরা পুরোটাই হারালাম। সামনে পবিত্র ঈদুল ফিতর। সব মিলিয়ে প্রতি বছর মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ভরা মৌসুম। মোট বিক্রির ৪০-৫০ শতাংশ হয় এ সময়।’

ভারতীয় ব্র্যান্ড বাজাজ, হিরো ও টিভিএস এবং জাপানের ব্র্যান্ড হোন্ডা, সুজুকি ও ইয়ামাহা এখন দেশেই তৈরি হয়। তাদের কিছু কিছু মডেলের মোটরসাইকেল সংযোজিত হয়। অন্যদিকে দেশীয় ব্র্যান্ড রানার অনেক আগে থেকেই দেশে তৈরি করছে। কোম্পানিগুলো কয়েক বছরে মোটরসাইকেল কারখানায় বিপুল বিনিয়োগ করেছে। বাজার হিস্যা বাড়াতে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল তারা।

জাপানি আরেক ব্র্যান্ড হোন্ডার বাংলাদেশে উৎপাদন ও বিপণনকারী বাংলাদেশ হোন্ডা লিমিটেডের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা গিয়াস উদ্দিন মনে করেন, বছরটা টিকে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে কাটবে। কারণ করোনা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সের, পোশাক খাত ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে মানুষ খরচ করা কমিয়ে দেবে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে মোটরসাইকেলের মতো শৌখিন পণ্যে।

ভারতে কারখানা বন্ধ
দেশে বেশির ভাগ মোটরসাইকেল আসে ভারত থেকে। আবার চীন ও ইন্দোনেশিয়া থেকেও কিছু কিছু আসে। ভারতে যন্ত্রাংশের একটি উৎস আবার চীন। ভারতে গত ২৪ মার্চ থেকে ২১ দিনের লকডাউন চলছে। এতে দেশটিতে কারখানা বন্ধ।

উত্তরা মোটরসের চেয়ারম্যান মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা কিছু কিছু সরবরাহ আদেশ বাতিল করেছি। নতুন করে সরবরাহ আদেশ দিতে গেলে তিন মাস আগে দিতে হবে। তারা সরবরাহ করতে পারবে কি না, সেটাও এখন বলা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।’

এসিআইয়ের সুব্রত রঞ্জন দাস বলেন, ভারত এখন মে-জুনের সরবরাহ আদেশ নিচ্ছে না। এমনও হতে পারে, বাজারে মোটরসাইকেলের ঘাটতি তৈরি হয়েছে।