ব্যাংক শাখায় ভিড়, আতঙ্কে কর্মকর্তারা

করোনাভাইরাসের কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে সেই দূরত্ব বজায় রাখা যাচ্ছে না। ছবি: সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে সেই দূরত্ব বজায় রাখা যাচ্ছে না। ছবি: সংগৃহীত
>অগ্রণী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত হওয়ায় ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখা লকডাউন করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ ওই কর্মকর্তা গত রোববার পর্যন্ত অফিস করেছেন। আজ করোনা পরীক্ষায় তাঁর আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়

রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে মাসের প্রথম দিকে সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হয়েছে। এখন চলছে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও সামাজিক ভাতাভোগীদের ৩৭ ধরনের ভাতা প্রদান। দ্বিতীয় সপ্তাহে শুরু হবে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন প্রদান। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত এভাবেই চলবে বেতন-ভাতা প্রদান কার্যক্রম। ফলে সারা দেশের ১ হাজার ২২৪ শাখায় লেগে থাকা জটলা কোনোভাবেই কমাতে পারছে না ব্যাংকটি।

করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটির কোনো বালাই নেই রাষ্ট্রমালিকানাধীন এ ব্যাংকটির বেশির ভাগ শাখায়। ঠাসাঠাসি করে লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে বয়স্ক ভাতা গ্রহীতাদের। ফলে একদিকে ঝুঁকিতে পড়ছে ব্যাংকটির কর্মকর্তারা, আবার গ্রাহকেরা যে নিরাপদ থাকছে তাও বলা যাচ্ছে না। এ নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ, সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ছবি দিয়ে প্রতিকার চাইছেন। তবে এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না, শাখায় ভিড় দিনে দিনে বাড়ছেই।

শুধু সোনালী ব্যাংকের অবস্থা এমন তা বলা যাবে না। সরকারি-বেসরকারি খাতের আরও অনেক ব্যাংকের পরিস্থিতি একই ধরনের। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় ভিড়ও চোখে পড়ার মতো।

এদিকে এরই মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের এক কর্মকর্তা করোনা আক্রান্ত হওয়ার ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখা লকডাউন করা হয়েছে। জ্যেষ্ঠ ওই কর্মকর্তা গত রোববার পর্যন্ত অফিস করেছেন। আজ করোনা পরীক্ষায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শাখাটি লকডাউন করে সব কর্মকর্তাকে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে। শাখাটির সব কার্যক্রম পার্শ্ববর্তী আমিন কোর্ট শাখা থেকে দেওয়া হবে।

এ ছাড়া করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা-উপজেলা লকডাউন করে দেওয়া হচ্ছে। যেসব এলাকা লকডাউন করে দেওয়া হচ্ছে সেসব এলাকার শাখাগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।

শাখা চিত্র
সরকারি ছুটির মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সীমিত আকারে ব্যাংক সেবা চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছে। তবে বেতন ভাতা প্রদানের কারণে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের সব শাখা খোলা রয়েছে। অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক অল্প কিছু শাখা খোলা রাখলেও জনতা ব্যাংক সব শাখা খোলা রেখেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোও তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শাখা খোলা রেখেছে। তবে সোনালী ব্যাংকের মতো ভিড় অন্য ব্যাংকগুলোতে নেই।

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিএবি) তাদের সব শাখা খোলা রেখেছে। সারা দেশে বিকেবির প্রায় ১ হাজার ৫০টি শাখা রয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী হোসেন প্রধানিয়া প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি ভাতা দিতে হয়, এ জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সব শাখা খোলা রাখা হয়েছে।

বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকের ৩৫৭ শাখার মধ্যে ২১৫টি খোলা রয়েছে। ব্যাংকটির গ্রাহক বেশি প্রায় দেড় কোটি। তাই সব শাখাতেই গ্রাহকের কম-বেশি ভিড় রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রায় ১১ হাজার ব্যাংক শাখার মধ্যে প্রায় ৪ হাজার শাখা খোলা আছে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলছে ব্যাংকিং কার্যক্রম। সরকারি ছুটির মধ্যে ব্যাংকারদের এক রকম বাধ্য হয়ে অফিস করতে হচ্ছে। এ জন্য কয়েকটি ব্যাংক কর্মীদের ঝুঁকি ভাতা দিলেও বেশির ভাগ ব্যাংকই তা করছে না।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান ব্যাংকটির ওয়েবসাইটে এক ঘোষণায় কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই দুঃসময়ে যারা ভয়ভীতি উপেক্ষা করে নিবেদিতভাবে কাজ করছেন তাদের কাজের মূল্যায়ন কোনো অবস্থাতেই পুরস্কারের বাইরে থাকবে না।’

এদিকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের ঠাকুরগাঁও শাখা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর শাখা, নওগাঁর পত্নীতলা শাখা, গাইবান্ধা শাখার কিছু ছবি বেশ আলোচনায় এসেছে। পুরো শাখা জুড়ে লোক গিজগিজ করছে, যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।

ব্যাংক খোলার রাখার কারণ সম্পর্কে সোনালীর এমডি আতাউর রহমান প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নানা ভাতা বিতরণের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন হয় আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে। তাই নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানবিক কারণে সেবা চালু রাখতে হচ্ছে।

ব্যাংক খোলা রাখা ও গ্রাহকের বাড়তি ভিড় প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া প্রথম আলোকে বলেন, আমরা গ্রাহকদের বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেছি, তারা যাতে এটিএম, সিডিএমসহ ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করেন। এরপরও শাখায় ভিড় সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।

ব্যাংকাররা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে যেমন ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, নিরাপত্তা নিয়েও অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় যেখানে সামাজিক দূরত্বই প্রধান উপায়। সেখানে আমরা ব্যাংক সেবা দিচ্ছি খুব কাছাকাছি অবস্থান থেকে। ব্যাংকে যাওয়ার সময় হয়রানি তো রয়েছেই। আবার কোনো যানবাহনও নেই। অনেক সময় হেঁটেও অফিস যেতে হচ্ছে।

বাড়ছে সেবা

সরকারি ছুটি চলাকালে সীমিত আকারে ব্যাংক সেবা চালু রাখার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথমে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত টাকা জমা ও উত্তোলনের পাশাপাশি শুধু জরুরি বৈদেশিক লেনদেন চালুর কথা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২৫ মার্চ জানায়, ডিডি ও পে অর্ডার সেবা চালুর কথা। এরপর ২ এপ্রিল লেনদেনের সময়সীমা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ট্রেজারি চালান জমা ও ক্লিয়ারিং ব্যবস্থার আওতাধীন বিভিন্ন সেবা চালুর ঘোষণা দেয়। এরপর সঞ্চয়পত্র নগদায়ন ও প্রতি মাসের মুনাফা তোলা, বৈদেশিক লেনদেন শাখাসমূহের সেবা দুপুর ২টা পর্যন্ত চালু রাখার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে করোনা পরিস্থিতি যত খারাপ হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর সেবার সংখ্যা যেন ততই বাড়ছে।

বিকল্প প্রস্তাব কী
ব্যাংক সেবা চালু রেখে বিকল্প কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন ব্যাংকাররাই। এর মধ্যে রয়েছে, ব্যাংক সেবা শুধু টাকা জমা ও উত্তোলনের মধ্যে সীমিত রাখা। যাদের এটিএম কার্ড রয়েছে, তাদের শাখা থেকে টাকা উত্তোলন বন্ধ করা। শাখায় গ্রাহক প্রবেশ সীমিত করা। জোর ও বিজোড় হিসাব নম্বর ধরে আলাদা আলাদা দিন সেবা দেওয়া। যারা প্রতি মাসে ছোট অঙ্কের টাকা জমা করে, আপাতত তাদের টাকা জমা স্থগিত। এ ছাড়া ব্যাংকের কার্যদিবস কমিয়ে আনার প্রস্তাবও দিয়েছেন কেউ কেউ।