এপ্রিলের শেষে দরিদ্র মানুষের খাদ্যসংকট চরমে পৌঁছাবে: পিপিআরসি-বিআইজিডি

হোসেন জিল্লুর রহমান
হোসেন জিল্লুর রহমান

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মাঝারি, অতিদরিদ্র মানুষেরা চরম বিপর্যয়ে পড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি দেশে নতুন করে এক দরিদ্রশ্রেণির সৃষ্টি হচ্ছে। করোনা–পরিস্থিতিতে শহরাঞ্চলে কর্মজীবী মানুষের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ। গ্রামে এটা ৭৯ শতাংশ। আর নতুন সৃষ্ট দরিদ্রশ্রেণির ৭১ শতাংশ আয় কমে গেছে।
পরিস্থিতি এখন যা, তাতে এসব পরিবার মাত্র এক থেকে দুই সপ্তাহ আর চলতে পারবে। এসব মানুষের জন্য জরুরি সহায়তা দরকার। এতে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা দরকার। সরকারের প্রথাগত ত্রাণ সহায়তার বাইরে এসে এখন জরুরি ভিত্তিতে এ সহায়তা দিতে হবে। আর জরুরি ভিত্তিতে ওএমএস চালু করতে হবে।

জরিপে পরিবারগুলো জানায়, সংকট শুরু হওয়ার পর ব্যক্তিগত সঞ্চয় বা ধারদেনা করে তারা চালাচ্ছে। কিন্তু এখন অর্থ ও খাদ্যসহায়তা না পেলে আর মাত্র ১০ দিন টিকতে পারবে তারা। তাই এ মাসের শেষে এসব পরিবারের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়বে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) করা এক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। আজ বৃহস্পতিবার এক ভিডিও কনফারেন্সে ‘পোভার্টি ইমপ্যাক্ট অব কোভিড–১৯’ শীর্ষক এ গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। মোট ৫ হাজার ৪৭১টি পরিবারের ওপর এ জরিপ চলে। দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কাছে ইতিমধ্যে থাকা একটি তথ্যভান্ডার থেকে টেলিফোনের মাধ্যমে মতামত গ্রহণ করা হয়।

আজ মূল গবেষণাপত্র তুলে ধরেন বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন। তিনি জরিপের উপাত্ত তুলে ধরে বলেন, ৪ থেকে ১২ এপ্রিল এ জরিপ হয়। যেসব পরিবারের ওপর জরিপ হয়েছে এগুলোর গড় আকার ৪ দশমিক ৮৫। তিনটি দরিদ্রশ্রেণির ওপর জরিপ হয়েছে। তাদের মধ্যে নিম্ন দরিদ্রশ্রেণির মানুষই বেশি, ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ। ১৫ শতাংশ উচ্চ দরিদ্রশ্রেণি, আর ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশের মানুষেরা নতুন দরিদ্র। এসব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাধারণ দিনমজুর, তাঁদের সংখ্যা ৪১ শতাংশ। এ ছাড়া আছেন কৃষক, নিয়মিত মজুরি পাওয়া শ্রমিক, ছোট ব্যবসায়ী।

পিপিআরসি–বিআজিডির গবেষণায় বলা হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিম্ন আয়ের মানুষের আয় ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।

শহুরে দরিদ্র মানুষদের আয় গত ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় ৮২ শতাংশ কমে গেছে। আর গ্রামের দরিদ্র মানুষের আয় কমে গেছে ৭৯ শতাংশ। তিন ধরনের দরিদ্রশ্রেণির আয় গড়ে ৭৬ শতাংশ কমে গেছে।

করোনার কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে শহরে কাজ হারিয়েছেন ৭১ শতাংশ শ্রমজীবী মানুষ। গ্রামে এ সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, ৫৫ শতাংশ। এ পরিস্থিতিতে খাবারের জন্য ব্যয় কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শিকার নতুন দরিদ্ররা। তাদের ৩৬ শতাংশ ব্যয় কমাতে হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এসব মানুষের পুষ্টি পরিস্থিতির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। সেখানে পুষ্টির পরিমাণ কমেছে ২৩ শতাংশ, গ্রামে ১৫ শতাংশ। শহরে মানুষের খাবারের পরিমাণ কমে গেছে ৪৭ ভাগ, গ্রামে ৩২ ভাগ।

এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে নিজেদের খাবার সংগ্রহ করছে? বেশির ভাগ মানুষ বলেছে, এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের করা সঞ্চয় ভাঙছে। আর এর পাশাপাশি ধারদেনা করে বা প্রতিবেশী বন্ধু ও আত্মীয়দের সহযোগিতা নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। আর খাবার কমিয়েও এ পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝছে মানুষ। মাত্র ১৪ শতাংশের মতো মানুষ বলেছে, তারা সরকারি সহায়তা পেয়েছে। আর ৫ শতাংশ পেয়েছে এনজিওর সহায়তা।

এভাবে নিম্ন আয়ের মানুষের খাবারের জন্য লড়াই বেশি দিন চালাতে পারবে না। গ্রামের মানুষেরা বলেছেন, তাঁরা হয়তো ১৩ দিন চলতে পারবেন। কিন্তু শহরে আট দিনের বেশি মানুষ চলতে পারবেন না।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, পরিস্থিতি এমন যে এ মাসের শেষের দিক থেকে বিপুলসংখ্যক নিম্ন আয়ের মানুষ বড় ধরনের খাদ্যসংকটে পড়বে। এ অবস্থায় তাদের জন্য সহায়তা দরকার।

জরিপের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর বলেন, গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো ৬ হাজার ৬০০ টাকা এবং শহরে থাকা দরিদ্র পরিবারগুলো ৮ হাজার ১০০ টাকার মধ্যে এক মাস চলতে পারে। আর এসব মানুষকে জরুরি ভিত্তিতে এক মাসের সহযোগিতা দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা দরকার। এটা শুধু এক মাসের জন্য। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে আরও সহযোগিতা লাগবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর বলেন, সরকারের প্রথাগত যে ত্রাণসহায়তার ধরন, তা দিয়ে এবারের পরিস্থিতি সামলানো যাবে না। এ জন্য ভিন্ন ভাবনার দরকার। সবচেয়ে জরুরি, দ্রুত ওএমএস চালু করা। সামাজিক দূরত্ব পালনে সমস্যা থাকলে তা যাতে পালন করা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে যাদের নিয়োজিত করার, তাদের করতে হবে।

এই জরিপের বিষয়ে কথা হয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘সরকারের হাতে পর্যাপ্ত খাদ্য আছে। তাই এ মাস শেষে পরিস্থিতি খারাপ হবে বলে মনে করি না।’
তবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের চরম দরিদ্র ১০ শতাংশ, মাঝারি দরিদ্র ১০ শতাংশ আর পরিস্থিতির কারণে আরও ৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র অবস্থায় পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে গবেষণায় যে অর্থের কথা বলা হয়েছে, তা হয়তো ঠিক আছে। তবে পরিস্থিতি খারাপ হবে না।