চীনা আদার এক লাফে এত উঁচুতে ওঠার কারণটা কী

আদা। প্রথম আলো ফাইল ছবি
আদা। প্রথম আলো ফাইল ছবি

চাহিদার তুলনায় বাজারে আদার সরবরাহ কম। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে তিন মাসে আদা আমদানি প্রায় ৫৯ শতাংশ কমেছে। নতুন করে ব্যবসায়ীরা আদা আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। আবার বন্দরে জটের কারণেও বহির্নোঙরে কিছু পরিমাণ আদার চালান আটকে আছে। করোনায় পরিবহন–সংকটও যোগ হয়েছে এতে। চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহ সংকট হলে বাজারে যে দাম বাড়বে, এর প্রতিফলন ঘটেছে আদার দামে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ বা টিসিবি প্রতিদিন নিত্যপণ্যের বাজারদর প্রকাশ করে। এই তালিকা অনুযায়ী, এক মাসের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে মসলাজাতীয় পণ্য আদার। এই পণ্যটির কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ১৫০ টাকা। কেজিপ্রতি যে দাম (১৫০ টাকা) বেড়েছে, সেই টাকা দিয়েই এখন চীন থেকে দেড় কেজি আদা আনা যায়। চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত আনতে এই খরচ পড়বে। তাহলে কেন হঠাৎ করে আদার দাম এত বেড়ে গেল?


দাম বাড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে হলে প্রথমে কয়েকটি তথ্যের খোঁজ নিতে হয়। দেশীয় উৎপাদন, আমদানি, বিশ্ববাজারে দাম, সরবরাহব্যবস্থা –ইত্যাদি তথ্যই দাম বাড়ার কারণ বিশ্লেষণে সহায়তা করে। সব তথ্য পর্যালোচনা করে আদার দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বলা যায়, চাহিদার তুলনায় বাজারে আদার সরবরাহ কম। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে তিন মাসে আদা আমদানি প্রায় ৫৯ শতাংশ কমেছে। নতুন করে ব্যবসায়ীরা আদা আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছেন না। আবার বন্দরে জটের কারণেও বহির্নোঙরে কিছু পরিমাণ আদার চালান আটকে আছে। করোনায় পরিবহন–সংকটও যোগ হয়েছে এতে। চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহের সংকট হলে বাজারে যে দাম বাড়বে, সেটির প্রতিফলন ঘটেছে আদার দামে।


আদার চাহিদা কত, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে দেশে আদার আমদানি ও উৎপাদন হিসাব করে মোটামুটি চাহিদা হিসাব করা যায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে আদা আমদানি হয় এক লাখ ২৮ হাজার ৬০৭ টন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, একই সময়ে দেশে আদা উৎপাদন হয় ৮০ হাজার ২৩৪ টন। অর্থ্যৎ, গত অর্থবছর দেশে বছরে আদার আনুমানিক সরবরাহ বা চাহিদা ছিল দুই লাখ টনের একটু বেশি। এর আগের অর্থবছরের চেয়ে আদার সরবরাহ বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।


গত অর্থবছরের সরবরাহ ও প্রবৃদ্ধি ধরে নিলে এখন প্রতি মাসে আদা দরকার ১৯ হাজার টন। প্রতি মাসে এই চাহিদার প্রায় ৬২ শতাংশ বা ১১ হাজার ৭৮৮ টন আমদানি করে মেটাতে হবে। এবার আমদানির চিত্র দেখা যাক। সবচেয়ে বড় স্টেশন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে মোট আমদানির ৭৬ শতাংশ আনা হয়। চট্টগ্রাম কাস্টমস এর তথ্যে দেখা যায়, বন্দরটি দিয়ে এ বছরের জানুয়ারি থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত আদা আমদানি হয় ১২ হাজার ৭৮২ টন। গত বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৩১ হাজার ৪০২ টন। অর্থ্যা,ৎ এ সময়ে আমদানি কমেছে প্রায় ৫৯ শতাংশ।


বাজারে ভালো দাম থাকলে ব্যবসায়ীরাও আমদানির জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। ব্যাংকগুলোও অর্থায়ন করে মুনাফার আশায়। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। আমদানিকারকেরা অভিযোগ করেছেন, অনেক ব্যাংক ঋণপত্র খুলতে আগ্রহী হচ্ছে না। এতে সামনে আদা আমদানির খুব সুখবর নেই। খাতুনগঞ্জের ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার ফারুক আহমেদ অনিয়মিতভাবে আদা আমদানি করেন। বাজারে আদার দাম বাড়তে থাকায় তিনিও ব্যাংকে যান ঋণপত্র খুলতে।


অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে প্রথম আলোকে ফারুক বলেন, এক সপ্তাহ ধরে ঘুরেও আদা আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারিনি। অথচ চীন থেকে প্রতি টন আদা চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত আনতে খরচ পড়ছে এক হাজার ১৫০ ডলার (কেজিপ্রতি ৯৮ টাকা)। থাইল্যান্ডে আরও কম। এখন আমদানি করলে কেজিপ্রতি দাম পড়বে ৮১ টাকা। বাজারজাত পর্যন্ত এর সঙ্গে ১০–১৫ শতাংশ খরচ যোগ হবে।


আদা আমদানিতে এগিয়ে ঢাকার ব্যবসায়ীরা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া আদার ৭০ শতাংশই আমদানি করেন তারা। প্রায় ২৫ শতাংশের মতো বাজার চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের হাতে। শীর্ষ দশ ব্যবসায়ী আদা আমদানি করেন মোট আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশ। এই তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ফরহাদ ট্রেডিং। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার নুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, করোনার প্রভাবে চীন থেকে আদা আমদানি কমে গেছে। আমদানির ঋণপত্র খোলার পাশাপাশি বন্দর থেকে খালাসেও সমস্যা হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে ব্যাংকগুলো যাতে আদা আমদানির ঋণপত্র খোলে সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। আবার বন্দরে পণ্য খালাস দ্রুত করার ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সরবরাহ বাড়লে দামও সহনীয় হয়ে আসবে।


বাজারে বিদেশি আদার যখন এত দাম, তখন দেশীয় আদার কী হাল? বিদেশি আদার চেয়ে বাজারে দেশীয় আদার দাম অর্ধেক। এখন কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে দেশীয় আদা। পরিসংখ্যান ব্যুরো'র তথ্য বলছে, দেশের নয়টি জেলা বাদে ৫৫ জেলায় আদা উৎপাদন হয়। সবচেয়ে বেশি রাঙামাটিতে। দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ২০ শতাংশ আসে এই জেলাটি থেকে। এরপরের অবস্থান রংপুরের নীলফামারি জেলা, ১৬ শতাংশ। এ ছাড়া খাগড়াছড়ি, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহেও আদা কম-বেশি উৎপাদন হয়। সবমিলিয়ে এই পাঁচ জেলা থেকে আসে দেশীয় আদার ৬৩ শতাংশ। গত বছরের শেষদিক থেকে কয়েকমাস ধরে দেশীয় আদার ফলন তুলেছেন কৃষকেরা। এখন নতুন করে রোপন হচ্ছে। চলবে মে পর্যন্ত। নতুন ফলন উঠবে বছর শেষে।


ক্রেতাদের কাছে দেশীয় আদার কদর কম। অথচ গুণগতমানে দেশীয় আদা ভালো বলে কৃষিবিদেরা জানিয়েছেন। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক পবন কুমার চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি আদার চেয়ে দেশি আদার গুণগতমান ভালো। ঝাঁজ বেশি। দামও কম। কিন্তু বিদেশি আদার মতো পরিষ্কার না বলে ক্রেতাদের ঝোঁক কম। তবে সচেতন মানুষ দেশি আদাই বেশি ব্যবহার করেন।


ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনার কারণে এখন আমদানি ও সরবরাহের সহজ কাজ কঠিন হয়ে পড়ছে। আদার এ সংকটে খুব দ্রুত আমদানি বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। আদা দ্রুত আমদানি করা যায় ভারত ও মিয়ানমার থেকে। ভারতে লকডাউনের কারণে এখন কিছুটা কঠিন। মিয়ানমারেও একই অবস্থা। তবে পরিমাণে কমলেও সেখান থেকে এখনো আদা আমদানি হচ্ছে। আদা আমদানির ৪৩ শতাংশ আসে দেশটি থেকে। আবার চীন থেকে আমদানিতে যেন সমস্যা না হয়, সেটিও নজর দেওয়া উচিত। দেশটি থেকে আদা আমদানি হয় সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৪৫ শতাংশ।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইদ্রিস প্রথম আলোকে বলে, এ মুহূর্তে বাজারে সরবরাহ বাড়ানোই শেষ কথা। সরবরাহ বাড়লে দাম কমে যাবে। অন্তত বন্দরে নানা কারণে যেসব কনটেইনার আটকে আছে, সেগুলো খালাস হলেও বাজার সরবরাহ কিছুটা বাড়বে।