শ্রমিকেরা কারখানায় ফিরছেন, সামাজিক দূরত্ব মানছেন না

অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গেছে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে। এক মাস ছুটির পর ঝুঁকি নিয়েই কাজে যোগ দিয়েছেন শ্রমিকেরা। এত দিন শহরের তেমন শোরগোল না থাকলেও কাল চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকা ফিরে আসে পুরোনো চেহারায়। সারা দিন কাজ শেষে বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় বাড়ি ফিরছেন শ্রমিকেরা। গতকাল বিকেল চারটায়।  ছবি: জুয়েল শীল
অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে গেছে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে। এক মাস ছুটির পর ঝুঁকি নিয়েই কাজে যোগ দিয়েছেন শ্রমিকেরা। এত দিন শহরের তেমন শোরগোল না থাকলেও কাল চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকা ফিরে আসে পুরোনো চেহারায়। সারা দিন কাজ শেষে বৃষ্টিতে ছাতা মাথায় বাড়ি ফিরছেন শ্রমিকেরা। গতকাল বিকেল চারটায়। ছবি: জুয়েল শীল

ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া,র, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে বন্ধ থাকা রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা সীমিত আকারে গতকাল রোববার খুলেছে। করোনার সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কারখানাগুলো চালু করা হয়েছে। তবে কারখানার বাইরে চলাচলের ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা সামাজিক দূরত্ব মানছেন না। 

পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ নিষেধের পরও দূরদূরান্ত থেকে শ্রমিকেরা ঝুঁকি নিয়েই কর্মস্থলে ফিরছেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কর্মস্থলে ফিরতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাঁদের। 


করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ৫ এপ্রিল থেকে কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ। সরকারি ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে তা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এরপর গতকাল থেকে সীমিত পরিসরে ধাপে ধাপে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেয় সংগঠন দুটি। 


এদিকে সীমিত আকারে কারখানা খোলার দিনে গতকাল মার্চের বকেয়া মজুরির দাবিতে রাজধানীর মালিবাগের একাধিক পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন। এ ছাড়া গাজীপুরে টঙ্গী, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্থানেও বকেয়া মজুরির দাবি ও ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছেন শ্রমিকেরা।


বিকেএমইএর পক্ষ থেকে শুধু স্যাম্পল, নিটিং ও ডায়িং সেকশন চালুর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আর বিজিএমইএ গতকাল থেকে ঢাকা মহানগরীর ২১৩টি কারখানা চালুর নির্দেশনা দিয়েছিল। তবে গতকাল ঢাকা মহানগরী ছাড়াও অন্যান্য এলাকার কারখানাও চালু হয়।


শিল্প পুলিশ জানায়, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনায় বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ৪৮০ কারখানা গতকাল থেকে চালু হয়েছে। এসব এলাকায় বিকেএমইএর ১২১টি ও বিটিএমএর সদস্যভুক্ত ৫৮টি বস্ত্রকল খুলেছে। সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনায় পোশাকসহ অন্য শিল্পকারখানা রয়েছে ৭ হাজার ৬০২টি। তার মধ্যে গতকাল চালু ছিল ১ হাজার ৪২৭টি।


জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি ফয়সাল সামাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘উৎপাদন চালুর জন্য প্রায় এক হাজার কারখানা নিবন্ধন করেছিল। আমরা তাদের ধাপে ধাপে চালু করার নির্দেশ দিয়েছি। তার বাইরে কেউ খুললে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে করেছে।’ সংগঠনটির আরেক সহসভাপতি আরশাদ জামাল বলেন, দূরদূরান্ত থেকে শ্রমিকদের আপতত না আনতে এবং কাউকে ছাঁটাই না করতে প্রত্যেক সদস্যকে বলা হয়েছে।

 
বিকেএমইএর ২০ শতাংশ কারখানা গতকাল থেকে সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে বলে জানান বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দূরদূরান্ত থেকে শ্রমিকদের কাজে না আনতে আমাদের নির্দেশনা ছিল। তারপরও শ্রমিকেরা কেন ফিরছেন, তা বোধগম্য নয়।’
সাভার থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সাভার ও আশুলিয়ায় দুই শতাধিক পোশাক ও বস্ত্র কারখানা চালু হয়েছে। কারখানাগুলো শ্রমিকের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নিয়েছে।


আশুলিয়ায় শারমীন গ্রুপের পাঁচটি কারখানায় কাজ করেন প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে গ্রুপটির সব কটি কারখানায় দুই পালা (শিফট) চালু করা হয়েছে। গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসমাইল হোসেন বলেন, দুই শিফট চালু করায় শ্রমিকেরা ছয় ফুট দূরত্বে বসে কাজ করতে পারছেন। 


সাভারের কয়েকটি কারখানা ঘুরে দেখা যায়, কারখানার ভেতরে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা হলেও বাইরে আসা–যাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিকেরা তা মানছেন না। 


নারায়ণগঞ্জ থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানান, নারায়ণগঞ্জের ৮১টি পোশাক কারখানা গতকাল চালু হয়েছে। সেখানে শ্রমিকের উপস্থিতি ছিল ২৫ শতাংশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আদমজী ইপিজেডের ইপিক গার্মেন্টসের এক কর্মকর্তা জানান, কারখানার প্রবেশমুখে জুতা ও হাতে জীবাণুনাশক তরল স্প্রে করে তারপর শ্রমিকদের ভেতরে ঢোকানো হয়। 


আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, সেখানকার পোশাক ও বস্ত্র মিলিয়ে ৪৩৮টি কারখানা গতকাল চালু হয়েছে। বেশ কিছু কারখানায় থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করে শ্রমিকদের ভেতরে ঢোকানো হয়। এ ছাড়া সব শ্রমিকের হাত ধোয়া ও মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, সেখানকার প্রায় দুই শ কারখানা গতকাল খুলেছে। কারখানায় যেতে যানবাহন না পেরে ভোগান্তিতে পড়েন বেশির ভাগ শ্রমিক। যানবাহন না পেয়ে গতকাল সকালে দুই শতাধিক শ্রমিক নগরীর বালুছড়া নতুনপাড়া এলাকার সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন। চট্টগ্রামের ইপিজেডে ৭০টি ও কেইপিজেডে ২০টি কারখানা গতকাল খুলেছে। সিইপিজেডের বেশ কয়েকটি কারখানায় বসেছে থার্মাল স্ক্যানার। সেই যন্ত্র দিয়ে শরীরের তাপমাত্রা মেপে শ্রমিকদের কারখানায় প্রবেশ করানো হয়। একইভাবে কেইপিজেডের কারখানাগুলোর ফটকেও থার্মাল স্ক্যানার বসানো হয়।


বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ বা বেপজার মহাব্যবস্থাপক খুরশিদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ২৫ শতাংশ শ্রমিক দিয়ে কিছু কারখানা চালু করা হয়েছে। কারণ, এসব কারখানার হাতে বিদেশি ক্রেতাদের বেশ কিছু ক্রয়াদেশ ছিল। ক্রেতারা দ্রুত পণ্য সরবরাহের জন্য চাপ দিচ্ছিল।


চট্টগ্রামে বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোর মধ্যে এক–তৃতীয়াংশ গতকাল খোলা ছিল বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির প্রথম সহসভাপতি এম এ সালাম।


আমাদের মুন্সিগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলার শিমুলিয়া ঘাটে গতকাল ঢাকামুখী পোশাকশ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের ভিড় ছিল। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাঁদের। ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) শাফায়াত আহম্মেদ বলেন, শিমুলিয়ার চারটি ঘাটের মধ্যে মাত্র একটি সচল। ফেরিতে যাত্রীদের উঠতে নিষেধ করলেও তাঁরা তা উপেক্ষা করে গন্তব্যে ছুটেছেন।