ভয়কেই কাজে লাগানো হচ্ছে, এটাই প্রকৃত ঝুঁকি

>করোনার কারণে বিশ্ব আজ বলতে গেলে অবরুদ্ধ। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। ভেঙে পড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থা, স্থবির অর্থনীতির চাকা। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে পরিবহন-যোগাযাগ বন্ধ। এক দেশের মানুষ অন্য দেশে যায় না, যেতে পারেও না। এমনকি পাশের বাড়ি কিংবা পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও আসা-যাওয়া নিষেধ। সব মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় বিশ্বজুড়ে থমকে গেছে মানবজীবন। তবে এটিই শেষ কথা নয়। করোনার এই পরিস্থিতি থেকে একদিন মুক্তি পাবে পৃথিবী। তখন কেমন হবে বৈশ্বিক অর্থনীতির চালচিত্র? অর্থনীতির বিশ্বখ্যাত বিশ্লেষক শুনিয়েছেন আশার কথা, ভয়াবহ এই মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে চিরতরে বদলে দেবে। স্থায়ী পরিবর্তন ঘটবে রাজনীতিরও। অভিমতগুলো নিয়েছে ফরেন পলিসি ডটকম।
গীতা গোপীনাথ
গীতা গোপীনাথ

মাত্র কয়েক সপ্তাহ ধরে কী নাটকীয়তাই না দেখা গেছে। মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হচ্ছে, বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন বা সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, মেডিকেল সাপ্লাই বা চিকিৎসাপণ্য জাহাজীকরণে বিঘ্ন ঘটছে। এসবের পরিণতিতে আমরা ১৯৩০ সালের পরে বিশ্বে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকোচন ও সংকট ত্বরান্বিত হতে দেখলাম। ঝুঁকি এড়াতে দেশে দেশে আন্তসীমান্ত চলাচল, মানে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়াটাও বন্ধ করে দেওয়া হলো, আর জনগণও নিজেদের ব্যক্তিগত ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ভ্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নিল, যা কিনা মানুষের বিগত ৫০ বছরের ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চলাচলের বিপরীত চিত্র।

কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার আগে থেকেই অবশ্য বৈশ্বিক অর্থনীতিতে দেশগুলোর সমন্বিত থাকার প্রবণতা কমে আসছিল। এতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে দিল করোনা মহামারি। যে কারণে বিশ্বায়নের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় সরাসরি সম্পৃক্ত রয়েছে এমন কোম্পানিগুলো পরস্পরের সঙ্গে নির্ভরতার কারণে ঝুঁকির মুখে পড়ল। সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় তারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এসব প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি এড়াতে বৈশ্বিক বাণিজ্যের চেয়ে স্থানীয়ভাবে ব্যবসা করার ওপরই বেশি জোর দেবে। যেসব উন্নয়নশীল দেশ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়ে পুঁজি স্থানান্তরের দ্বার উন্মোচন করেছিল, তারা হঠাৎ দেখা দেওয়া অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আবার তা নিয়ন্ত্রণের পথে চলবে। এভাবে বিশ্বব্যাপী যদি ক্রমান্বয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে জনগণও তাদের ব্যক্তিগত ঝুঁকি বিবেচনায় চলাচল সীমিত করে ফেলবে। অর্থাৎ একটি দেশের জনগণ তাদের আন্তর্জাতিক তথা অন্য দেশ ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকা বা তা কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নেবে, যা কিনা এর আগের অর্ধশতাব্দী ধরে বাড়ছিল।

 যাহোক, এখন প্রকৃত ঝুঁকি হলো, কতিপয় নীতিনির্ধারক রাজনীতিবিদ ভীতির কথা বলে বর্ডার বা সীমান্ত খুলতে চাইছেন না। ফলে সাধারণ জনগণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশ্বায়ন মানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে হবে। কারণ, ওই সব নীতিনির্ধারক-রাজনীতিবিদ নিজ নিজ দেশের স্বনির্ভরতা অর্জনের ধুয়া তুলে আন্তসীমান্ত বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। সেই সঙ্গে তাঁরা জনস্বাস্থ্যের অজুহাত দেখিয়ে সাধারণ জনগণের চলাচল নিয়ন্ত্রণেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেবে। সুতরাং বৈশ্বিক নেতারা ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে সমন্বিত প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক ঐক্য-সংহতির ধারা বজায় রাখবেন কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

গীতা গোপীনাথ: প্রধান অর্থনীতিবিদ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।