বিশ্বায়নের কফিনে আরেকটি পেরেক ঠুকল

>করোনার কারণে বিশ্ব আজ বলতে গেলে অবরুদ্ধ। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। ভেঙে পড়েছে সরবরাহ ব্যবস্থা, স্থবির অর্থনীতির চাকা। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে পরিবহন-যোগাযাগ বন্ধ। এক দেশের মানুষ অন্য দেশে যায় না, যেতে পারেও না। এমনকি পাশের বাড়ি কিংবা পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও আসা-যাওয়া নিষেধ। সব মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় বিশ্বজুড়ে থমকে গেছে মানবজীবন। তবে এটিই শেষ কথা নয়। করোনার এই পরিস্থিতি থেকে একদিন মুক্তি পাবে পৃথিবী। তখন কেমন হবে বৈশ্বিক অর্থনীতির চালচিত্র? অর্থনীতির বিশ্বখ্যাত বিশ্লেষক শুনিয়েছেন আশার কথা, ভয়াবহ এই মহামারি বিশ্ব অর্থনীতিকে চিরতরে বদলে দেবে। স্থায়ী পরিবর্তন ঘটবে রাজনীতিরও। অভিমতগুলো নিয়েছে ফরেন পলিসি ডটকম।
কারমেন এম রেইনহার্ট
কারমেন এম রেইনহার্ট

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও ১৯৩০-এর দশকের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে বিশ্বায়নের আগের জমানার অবসান হয়। এরপর বিভিন্ন দেশ নানা রকম বাণিজ্য–বাধা আরোপ করে। পুঁজির ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। এ ছাড়া আরও যে কারণে সেই ব্যবস্থার পতন হয়, তা হলো, অন্তত ৪০ শতাংশ দেশের ঘাটতিতে পড়ে যাওয়া। এতে অনেক দেশ বৈশ্বিক পুঁজিবাজার থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৫০-এর দশকের আগ পর্যন্ত তাদের পক্ষে সেই পুঁজিবাজারে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে দেখা গেল, নতুন ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ লগ্নি পুঁজি যেমন নিপীড়নের মুখে পড়েছে, তেমনি পুঁজির বহির্গমনের ওপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়েছে। আগের যুগের বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থায়নের সঙ্গে এর মিল রইল খুবই সামান্য।

অন্যদিকে ২০০৮-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর বিশ্বায়নের এই আধুনিক চক্র একাধিক ধাক্কা খেয়েছে—ইউরোপের ঋণসংকট, ব্রেক্সিট ও মার্কিন-চীন বাণিজ্যযুদ্ধ ইত্যাদি। এর মধ্যে আবার দেশে দেশে জনতুষ্টিবাদের উত্থান হয়। ফলে ঘরের জিনিস ঘরেই বানাও—এই স্লোগানের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।

কথা হলো, এখনকার এই করোনাভাইরাসের সংকটে ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর এই প্রথম উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ—উভয়ই সংকটে পড়েছে। তারা হয়তো দীর্ঘ ও গভীর মন্দার কবলে পড়েছে। ১৯৩০-এর দশকের মতো সার্বভৌম ঘাটতি বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। আর এই খারাপ সময়েই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পুঁজির বহির্গমন নিয়ন্ত্রণের আহ্বান আসে।

এরপর করোনা-পূর্ব বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণের নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হবে। আর জাতীয় পর্যায়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা, ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা—এসব নিয়ে উদ্বেগ দীর্ঘস্থায়ী হবে। এমনকি মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসার পরও এসব থেকে যাবে, যদিও এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ হতে পারে। করোনা-পরবর্তী আর্থিক কাঠামো আমাদের হয়তো ব্রেটন উডস যুগের প্রাক্‌বিশ্বায়নের পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না, তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অর্থায়ন ব্যবস্থার যে ক্ষতি হবে, তার পরিসর যেমন ব্যাপক হবে, তেমনি তা দীর্ঘমেয়াদিও হবে।

কারমেন এম রেইনহার্ট: হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের অধ্যাপক।