'৪৫ বছরে প্রথম' রোজায় গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ হলো না

ছবি: আবদুস সালাম
ছবি: আবদুস সালাম

বাজারে গরুর মাংসের দাম লাগামছাড়া। বেশির ভাগ বাজারে প্রতি কেজি মাংস ৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও দেশি ছোট গরু দাবি করে বিক্রেতারা মাংসের কেজি ৬৫০ টাকাও চাইছেন।

ঢাকায় গত মাসের শুরুর দিকেও গরুর মাংসের কেজি ৫৫০ টাকার মধ্যে ছিল। দাম নতুন করে বেড়েছে করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার আগে। সেটি আর কমার নাম নেই। অন্যদিকে পবিত্র রজমান মাসে ভোক্তাদের সুবিধার্থে সিটি করপোরেশন ও ব্যবসায়ীরা বৈঠক করে গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিতেন। এবার তাঁরা তা করেননি।

বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন ও আদার দাম চড়া। গরুর মাংসের দামে লাগাম টেনে মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার যে সুযোগটি ছিল, সেটাও ব্যবহার করল না সিটি করপোরেশন। মাংস ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে ৪৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম রোজায় মাংসের দাম নির্ধারণ করা হলো না।

সব মিলিয়ে এখন আর সীমিত আয়ের পরিবারে গরুর মাংস কেনার সাধ্য নেই। যদিও অনেকে গরুর মাংস পছন্দ করেন। অতিথি আপ্যায়নে অনেক পরিবারকে সাধ্য না থাকলেও মাংস কিনতে হয়।

চার-পাঁচ বছর আগেও নাগালের মধ্যেই ছিল। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দেশে গরুর মাংসের কেজিপ্রতি গড় দাম ২৭৫ টাকা ছিল। তখন ফার্মের ব্রয়লার মুরগির গড় দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৩৭ টাকা। ২০১৮ সালে গরুর মাংসের গড় দাম বেড়ে কেজিপ্রতি ৪৩০ টাকা হয়। আর মুরগির দাম কমে হয় কেজিপ্রতি ১৩১ টাকা।

এখন বাজারে গরুর মাংসের কেজি ৬০০ টাকা। আর ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৩০ টাকা।

বাজারে গরুর মাংসের দাম বাড়তে থাকে ২০১৪ সাল থেকে। ওই বছর ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে ভারতের গরু আনা সীমিত হয়ে যায়। এরপর দেশে গরু পালনে ঋণ দেওয়া, জাত উন্নত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়। অনেক তরুণ গরুর খামার করতে এগিয়ে আসেন। ফলে দেশে মাংসের উৎপাদন বাড়ে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৭৫ লাখ ১৪ হাজার টন মাংস উৎপাদিত হয়েছে, যা মোট চাহিদার চেয়েও বেশি। খামারমালিকদের সমিতি দাবি করে, দেশে এখন চাহিদা অনুযায়ী গরুর মাংস উৎপাদিত হচ্ছে। এ কারণ দেখিয়ে হিমায়িত মাংস আমদানির উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে তারা। সরকারও আমদানিতে আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু গরুর মাংসের দাম আর কমছে না।

প্রতিবছর রোজা শুরুর আগে সিটি করপোরেশন ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বৈঠকে র গরুর মাংসের দাম ঠিক করে দেওয়া হয়। গত বছর প্রতি কেজি মাংসের দাম ঠিক হয়েছিল ৫২৫ টাকা। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এবারও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছিল। তবে দাম নির্ধারণ হয়নি।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোমিনুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ প্রক্রিয়াধীন আছে। কারণ এখন যে অবস্থা তাতে মাংস ব্যবসায়ী ও সংবাদকর্মীদের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। এসব বিষয়ে ২২ এপ্রিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে যেভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে তা মানা হবে।’

মোমিনুর রহমান জানান, আজ সোমবার পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে কোনো উত্তর পাননি। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর দাম নির্ধারণের বিষয়টি দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে করা হতো। উত্তরেও আমরা সেভাবে কাজ করতাম। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তা সম্ভব হয়নি।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র জামাল মোস্তফা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মাংসের দাম নিয়ে বৈঠক হয়েছে বলে জানান মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা চেয়েছি গাবতলী গরুর হাটে সরকার নির্ধারিত খাজনা আদায় হোক। সঙ্গে আমাদের কার্যালয়টি দখলমুক্ত করা হোক। তাঁরা সেটা করতে না পারবেন না। এরপর আমরা চলে আসছি।’

রবিউল আলম বলেন, গাবতলী গরুর হাটকেন্দ্রিক কোটি কোটি টাকার গুমর ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে মাংসের দাম নির্ধারিত হয়নি।

এক কেজি গরুর মাংসের দামে এখন চার কেজি ব্রয়লার মুরগি পাওয়া যায়। চার কেজি তেলাপিয়া ও পাঁচ কেজি পাঙাশ মাছের দামের সমান এক কেজি গরুর মাংস। যদিও সবগুলোই বাণিজ্যিক খামারে উৎপাদিত।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘গরুর মাংস উৎপাদনে আমরা স্বাবলম্বী হয়েছি ঠিকই, তবে এ জন্য মূল্য দিতে হয়েছে। মাংস নাগালে আনতে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে।’ তিনি বলেন, রোজায় গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করা উচিত ছিল। তাহলে মানুষ একটু স্বস্তি পেত।