নগদ সহায়তাই বেশি কাজে লাগবে এখন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের প্রকোপে কাজ হারানো গরিব মানুষকে নগদ সহায়তা দিতে যাচ্ছে সরকার। ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে ঈদের আগে আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়া হবে। দেশে বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতার মতো বিভিন্ন ধরনের ভাতা দেওয়া হলেও কর্মহীনদের এভাবে নগদ সহায়তা দেওয়া এই প্রথম। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মহামারির মতো দুর্যোগের সময় নগদ সহায়তাই বেশি কাজে লাগে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই অর্থনীতিবিদেরা জনগণকে নগদ সহায়তা দেওয়ার কথা বলে আসছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে গরিব মানুষকে নগদ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এই ব্যাপারে বরাবরই সোচ্চার গত বছরের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি। তিনি অনেকবারই বলেছেন, অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে হলে গরিব মানুষের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার বিকল্প নেই। সরকার অবশেষে সেই পথে হাঁটতে শুরু করেছে।

অন্যদিকে এ রকম ছোঁয়াচে রোগের মহামারির সময় ত্রাণ বিতরণ করা অনেক ঝামেলাপূর্ণ। দেখা যাচ্ছে, পাড়া-মহল্লায় ত্রাণ বিতরণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না। সে জন্য বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই মানুষদের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ সহায়তা দেওয়া গেলে এই সমস্যা অনেকটাই মিটত। তবে এ জন্য বাড়িতে বাড়িতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দোকানে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

বিশ্লেষকেরা মনে করেন, গরিব মানুষের হাতে নগদ টাকা দেওয়ার মূল সুবিধা হলো, এতে তাঁদের স্বাধীনতার পরিসর বাড়ে। গ্রামাঞ্চলেও এখন প্রায় সব ধরনের পণ্য পাওয়া যায়। গরিব মানুষ এই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারবেন, তবে এই টাকার একাংশ অপব্যয় হবে, এমন আশঙ্কাও থাকে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে টাকার সঞ্চালন বাড়বে।

দ্বিতীয়ত, এতে গরিব মানুষ নগদ টাকার সংকট থেকে রক্ষা পাবে। তাঁদের তখন মহাজন বা ক্ষুদ্র ঋণের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা কমবে। যাঁরা কিছুটা গঠনমূলক, তাঁরা হয়তো সেখান থেকে কিছু সঞ্চয়ও করতে পারবেন; মোবাইল হিসাবে এই টাকা থাকলে তা জিডিপিতেও অন্তর্ভুক্ত হবে।

তৃতীয়ত, নগদ টাকা হস্তান্তর ঝামেলাহীন ও সাশ্রয়ী। মোবাইল ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সরকার হাজারে ছয় টাকায় এই হস্তান্তর করতে পারছে। এমএফএস কোম্পানিগুলোও জানিয়েছে, তারা সরকারের এই জনহিতকর কাজে যুক্ত থাকতে পেরে আনন্দিত, যদিও এতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে। সাধারণত এমএফএস থেকে টাকা তুলতে এক হাজারে ১৮ টাকা ৫০ পয়সা খরচ হয়, যদিও বাস্তবে তা ২০ টাকা পড়ে যায়। পাশাপাশি এতে জনবলের সম্পৃক্ততা নেই। ওএমএসে চাল বিতরণ করতে যে জনবল ও সরঞ্জাম লাগে, তার কিছুই এতে লাগছে না। ফলে প্রশাসনকে এর জন্য বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে না। তবে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বোপরি, ত্রাণ বিতরণে বা অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে যে পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি ও দুর্নীতি হয়, নগদ সহায়তা দেওয়া হলে তার অবসান হবে। ফলে এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। এতে গরিব মানুষকে আর নেতাদের পিছু পিছু ঘুরতে হবে না। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে সরকার নগদ সহায়তা দেয়, তার প্রতি জনগণের সমর্থন থাকে।

ভারতে রান্নার গ্যাসে ভর্তুকির ফাঁকফোকর বন্ধ করতে নাগরিকদের হিসাবে সরাসরি টাকা পাঠানো শুরু হয়। সেই প্রক্রিয়া থেকেই ভারতে আধার কার্ড ব্যবস্থা চালু হয়। এখন সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা এই আধার কার্ডের ভিত্তিতে দেওয়া হচ্ছে। এরপর সারেও ভর্তুকি দেওয়ার বদলে ভারত সরকার সেই টাকা কৃষকদের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো শুরু করে। এতে সেখানে সারের কালোবাজারি কমেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান এই প্রসঙ্গে বলেন, অনেক দিন ধরেই নগদ সহায়তার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছিল। অবশেষে তা হতে যাচ্ছে, যা খুবই প্রশংসনীয়। তবে এটি যেন একবার দেওয়ার মধ্যেই শেষ হয়ে না যায়। এটাকে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে, তেমনি সঠিক মানুষের কাছে যেন এটি পৌঁছায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। নগদ সহায়তার পাশাপাশি খাদ্যসহায়তাও দিয়ে যেতে হবে। আর ভারতের মতো আধার কার্ড করা গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। তখন সেই কার্ডের ভিত্তিতে সব সামাজিক সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।

অন্যদিকে নগদ সহায়তার এই টাকা পেতে গরিব মানুষের মোবাইল ব্যাংক হিসাব করতে হবে, এতে তাঁরা আর্থিক খাতের আওতায় চলে আসবেন। তখন সরকার চাইলে পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময় তাঁদের নগদ সহায়তা দিতে পারবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে যেসব অনিয়ম হয়, এতে তার সুযোগ অনেকটাই কমে আসবে। অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এটি হয়ে গেলে এই কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, ভারতের মতো আধার কার্ড অবশ্যই দরকার। এটি করাও সম্ভব, করলে ত্রাণ বিতরণের অনেক বাস্তব সমস্যা অনেক কমে যাবে। অনেকেই সরকারি-বেসরকারিভাবে একটু বেশি পাচ্ছে বা একাধিকবার পাচ্ছে, অন্যদিকে কেউ কম পাচ্ছে বা পাচ্ছেই না—আধার কার্ডে এমন সমস্যা কমে যাবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, মহামারিতে সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এখন যে সময়, তাতে অনেক কিছুই বদলানোর প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। সরকার সেগুলো নিয়ে ভাবতে পারে।