কোনোভাবেই সামাজিক অস্থিরতা যেন না হয়

করোনার কারণে সারা বিশ্বেই ছোট-বড় সব ব্যবসা-বাণিজ্য এখন কল্পনাতীত কঠিন পরিস্থিতির মুখে। এই মহামারির প্রথম আঘাত পড়েছে ভ্রমণ-পর্যটন ও হোটেল-রেস্তোরাঁ; পোশাক-ফ্যাশন; রপ্তানিমুখী পণ্য, রড-সিমেন্টের কারবারসহ নির্মাণ খাতে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে এসব খাত। ইতিমধ্যে কিছু কার্যক্রম চালু হলেও তা গতি পায়নি। কারণ, করোনা পরিস্থিতিতে এবং পরেও মানুষের চাহিদায় পরিবর্তন অনিবার্য। তাঁরা কেনাকাটা ও খরচে অনেক সংযত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। থাকবে নানামুখী চ্যালেঞ্জও। তাই ব্যবসায়িক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দীর্ঘ সময় লাগবে। জীবন নিয়ে শঙ্কার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়ানোর আশাবাদে ব্যবসায়ীরা তাঁদের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন। করোনার ব্যবসায়িক ক্ষতি কাটাতে এরই মধ্যে সরকার লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। ব্যবসায়ীরা চান সেই প্রণোদনার সঠিক বাস্তবায়ন, যাতে প্রকৃত ব্যবসায়ী ও ক্ষতিগ্রস্তরা এ সুবিধা পান। এসব নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। কথা বলেছেন মাসুদ মিলাদ, রাজীব আহমেদ, শুভংকর কর্মকার, সানাউল্লাহ সাকিব ও মাকসুদা আজীজ।
মো. সায়ফুল ইসলাম
সভাপতি, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি)

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য খাতে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে রপ্তানি আয় কমেছে ৩৮ শতাংশ। তবে শুধু এপ্রিলের হিসাবে রপ্তানি কম হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের আর দুই মাস বাকি। পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতির আশাও দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আমাদের রপ্তানি আয় ২২ কোটি ডলার (১ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা) কম হতে পারে।

আমাদের হাতে যেসব সরবরাহ আদেশ ছিল, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর তার বেশির ভাগই স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে আবার ৭০ শতাংশ বাতিল করা হয়েছে। দেশে ২৬ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সাধারণ ছুটিতে কারখানায় মাসখানেকের বেশি উৎপাদন একেবারেই শূন্য ছিল। এরপর যখন বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল করা হলো, তখন কারখানা খোলা হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন সেভাবে চলছে না, কারণ সরবরাহ আদেশ নেই। 

সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এটা স্বল্প সুদের ঋণ। কিন্তু টাকাটা আবার ফেরত দিতে হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের খাতে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা রপ্তানি কম হবে। উৎপাদন বন্ধ থাকল। কিন্তু পরিচালন ব্যয় করতেই হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা এখনো বাড়ছে। কিন্তু আমাদের যারা প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, চীন, কম্বোডিয়ার মতো দেশ কিন্তু আবার ব্যবসায় ফিরেছে। মানে হলো, প্রতিযোগীরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। এতে আমাদের ক্রয়াদেশগুলো তাদের কাছে যাওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। 

আমরা সাধারণত দুটি মৌসুম নিয়ে কাজ করি। আগামী মৌসুমের জন্য নমুনা তৈরির কাজ চলছে। আমরা ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারলে সরবরাহ আদেশ অন্য দেশে যাবে না। সরকার সীমিত আকারে কারখানা চালু রাখতে দিচ্ছে। ফলে এখন পর্যন্ত ক্রেতারা আমাদের কার্যক্রম নিয়ে সন্তুষ্ট।

করোনার প্রাদুর্ভাব কমার পর বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য আগের মতো সচল হবে, তখন আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে দেশে যেন কোনোভাবেই সামাজিক অস্থিরতা বা শ্রমিক অসন্তোষ না হয়। সে জন্য সরকার ও বেসরকারি খাতকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। মালিকদের উচিত যেকোনো মূল্যে দক্ষ শ্রমশক্তিকে ধরে রাখা। শ্রমশক্তি যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, তাহলে আবার তাদের একত্র করতে কিন্তু সময় লাগবে। তাই আমাদের দায়িত্ব হলো, সরকারের দেওয়া প্রণোদনা ও নিজস্ব সম্পদ দিয়ে শ্রমিকদের ধরে রাখা।

চামড়াজাত পণ্য পোশাকের মতো অত জরুরি নয়। তাই বিশ্বজুড়ে মানুষের আয় কমে যাওয়া, বেকারত্ব ইত্যাদির কারণে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কমতে পারে। সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলো চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে পারে।

তবে আশার দিকও আছে। অনেকেই চীন থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে চায়। পণ্যের উৎস দেশ হিসেবে আরও দু-একটি দেশকে তালিকায় রাখতে চায়। জাপান এ জন্য তহবিল গঠন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার রাষ্ট্রীয়ভাবে চীনের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে নেওয়ার নীতির কথা বলছে।

আমরা এ সুযোগ নিতে পারব কি না, তা নির্ভর করছে আমাদের প্রস্তুতির ওপর। আমাদের চ্যালেঞ্জের মধ্যেই সুযোগ। সামাজিক অস্থিরতা ও শ্রমিক অসন্তোষ যদি না হয়, মালিক ও সরকার যদি দায়িত্বশীল আচরণ করে, তাহলে চ্যালেঞ্জটাই আবার সুযোগে পরিণত হতে পারে।