দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা ৩৫ শতাংশ কমে গেছে

মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, পরিচালক, ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড
মোহাম্মদ আনিসুর রহমান, পরিচালক, ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড
>

করোনাভাইরাস দেশে কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিভিন্ন খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তার মধ্যে একটি খাত হলো দেশের দুগ্ধ শিল্প। এ খাতের একটি কোম্পানির প্রধান নির্বাহী বলছেন বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে। 

দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর প্রথম আঘাতটি আসে দুগ্ধশিল্পে। সারা দেশে দোকানপাট, রেস্তোরাঁ, সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটে। ফলে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা অর্ধেকে নেমে আসে। চাষি পর্যায়ে দুধ ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।

খামারিদের অনেকেই বড় কোম্পানির বাইরে বিভিন্ন মিষ্টিজাতীয় পণ্য উৎপাদনকারী ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানকে দুধ সরবরাহ করে। তারা বিপাকে পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। ওই সময় আমরা ব্র্যাক ডেইরির পক্ষ থেকে চুক্তিভিত্তিক খামারিদের বাইরে চার থেকে পাঁচ হাজার খামারির দুধ কেনা শুরু করি। দুই সপ্তাহ পর দেখা গেল, আমাদের পণ্যের বিক্রি কম। প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতাও ততটা বেশি নয়। তখন বাধ্য হয়েই চুক্তিভিত্তিক খামারিদের বাইরে অন্যদের দুধ কেনা বন্ধ করে দিতে হলো।

পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার পর চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। এর বাইরে মিষ্টির দোকান, ছানার দোকান ইত্যাদি কিছু কিছু খুলেছে। ফলে এখন দুধ ফেলে দিতে হচ্ছে না। এ ছাড়া প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দুধ বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিল, যা খামারিদের সহায়তা করেছে। তারপরও এখন দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা গত বছরের তুলনায় ৩০-৩৫ শতাংশ কম।

দেশে তিন শ্রেণির খামারি রয়েছেন। একাংশ শিক্ষিত তরুণ, যাঁরা বাণিজ্যিক খামার করেছেন। তাঁদের জন্য করোনার আঘাত কাটিয়ে ওঠা কঠিন। তবে তাঁদের ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। তাঁরা সরকারের ঘোষিত তহবিল থেকে কম সুদের ঋণ পাবেন। খামারিদের আরেক অংশ কৃষিকাজ বা অন্য কোনো কাজের পাশাপাশি গবাদিপশু পালন করেন। অন্য খাত থেকে আয় থাকায় এ শ্রেণিটি বড় সংকটে পড়বে না।

সবচেয়ে বিপাকে পড়বে খামারিদের সেই অংশটি, যাঁরা ছোট এবং খামারের বাইরে অন্য মাধ্যম থেকে কোনো আয় নেই। আবার সরকারের সহায়তা এঁদের হাতে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও কম।

দেশে মোট উৎপাদিত দুধের মাত্র ৭ শতাংশ ব্র্যাক, মিল্ক ভিটা, প্রাণের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো প্রক্রিয়াজাত করে। চাহিদার বড় অংশই পূরণ হয় আমদানি করা গুঁড়া দুধ দিয়ে। দেশে আমাদের চেয়ে বিদেশি গুঁড়া দুধের বাজার তিন গুণ বড়।

দেশের খামারিদের তরল দুধ দিয়ে এক কেজি গুঁড়া দুধ তৈরির খরচ পড়ে ৪২০ টাকার মতো। আর যদি কেউ নিউজিল্যান্ড থেকে ভালো মানের গুঁড়া দুধ আমদানি করে তার খরচ পড়ে ৩৩০ টাকার মতো। ফলে বাজারে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত গুঁড়া দুধ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। সব মিলিয়ে দুগ্ধশিল্পে লাভ নেই। এ কারণে কিন্তু দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসছে না। এর চেয়ে দুধ আমদানির ব্যবসা করা লাভজনক।

অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্কের মতো দেশগুলোতে গাভিপ্রতি উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি। দুগ্ধ খাতে ওই সব প্রচুর ভর্তুকি দেয়। এ কারণে তারা কম দামে দুধ বিক্রি করতে পারে। বাংলাদেশে দুগ্ধশিল্পের উন্নতির জন্য উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। এ জন্য চাই ভালো জাতের গরু। একই সঙ্গে এ খাতকে সুরক্ষা দিতে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন।

মাংস ও দুধের জন্য গবাদিপশু পালন দেশের তরুণদের কর্মসংস্থানের একটি বড় উৎস হতে পারে। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর দেশেই এখন প্রচুর খামার হয়েছে। তার বড় অংশের উদ্যোক্তা তরুণেরা। এ জন্য সরকারকে একটি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। দশ বছর মেয়াদি একটি পথনকশা তৈরি করে সে অনুযায়ী নীতি ঠিক করা যেতে পারে। আমাদের চাহিদা কত দাঁড়াবে, কতটা দেশে উৎপাদন করব, কতটা আমদানি করব, এসবের একটা পরিকল্পনা থাকতে হবে।

দেশে আমদানি করা গুঁড়া দুধের সিংহভাগ অন্যান্য খাদ্যশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই দুধ আমদানি কমলে শিশুরা খেতে পারবে না, এ যুক্তি ঠিক না।

পরিচালক, ব্র্যাক ডেইরি অ্যান্ড ফুড