এফডিআই আকর্ষণের সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ?

করোনাভাইরাসের প্রভাবের কারণে অনেক দেশ কারখানা স্থাপনের নতুন উৎস খুঁজছে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে বাংলাদেশও হতে পারে তাদের গন্তব্য।

বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি তাদের বিনিয়োগ স্থানান্তর করতে যাচ্ছে।  চীন থেকে সরে গিয়ে ইন্দোনেশিয়া, ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং ভিয়েতনামে কারখানা করতে চাইছে তারা। করোনাভাইরাসের কারণেই কোম্পানিগুলো এমন মনোভাব দেখাচ্ছে। তাহলে বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে? বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশকে বেছে নেবে না কেন তারা? কোনো কারণে বাংলাদেশ কি সুযোগ হারাচ্ছে? তাহলে করণীয় কি?

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে ঈদের আগে শেষ কার্যদিবস গতকাল বুধবার বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটির বৈঠক করেন সচিবালয়ে। বৈঠকে কয়েকজন মন্ত্রী, উপেদষ্টা, সচিব, ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্তৃপক্ষগুলোর প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন। এতে কেউ সরাসরি অংশ নেন, কেউবা অংশ নেন ভার্চুয়ালি। বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন পুরো বৈঠক সঞ্চালনা করেন।   

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, 'যেসব কোম্পানি বিনিয়োগ স্থানান্তর করবে, সেই সুযোগটা নেওয়া গেলে কর্মহীনতার ধাক্কাটা সামলানো যেত। আলোচনা করছি ঠিক আছে। সবকিছু হয়ত করবও আমরা। কিন্তু মূল ট্রেনটাই ফেল করব। দেখব ট্রেনটি আমাদের স্টেশন ছেড়ে চলে গেছে, আর আমরা উঠতে পারিনি।'

বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সহজে ব্যবসা সূচকের চিত্র জানতে চায় এবং সেখানে নেতিবাচক চিত্র পেলে আসতে চায় না, নিরুৎসাহিত হয়-এ কথা উল্লেখ করে টিপু মুনশি ইন্দোনেশিয়ার সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণের সুবিধাগুলো তুলে ধরেন। 

বাণিজ্যমন্ত্রী জানান, ইন্দোনেশিয়ায় ৭০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করলে পাঁচ বছরের জন্য ৫০ শতাংশ অবকাশ সুবিধা  দিচ্ছে। ৭০ লাখ থেকে ৭কোটি ডলার বিনিয়োগে দেওয়া হচ্ছে পাঁচ বছরের জন্য শতভাগ কর অবকাশ। এর চেয়ে বেশি বিনিয়োগ করলে দেওয়া হচ্ছে ২০ বছরের জন্য শতভাগ কর অবকাশ।  বাংলাদেশের বড় প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটিতে ৬০ শতাংশ শ্রমিকের বয়স ৪০ বছরের নিচে। এটা একটা বড় সুযোগ। বেতন-মজুরিও বাংলাদেশের চেয়ে ৪০-৫০ শতাংশ বেশি। ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও ভিয়েতনামের কাগজপত্র অনুসরণ করে বাংলাদেশের এফডিআই আকর্ষণের ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন।

উজবেকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার উদাহরণ টেনেও বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, দেশটি বিনিয়োগ করতে চায়। দাবি হচ্ছে দ্বৈতকর পদ্ধতিটা বাদ দেওয়া। ভারতও নতুন শ্রম আইন করেছে। এতে বলা হয়েছে আগামী তিন বছর কোনো শ্রম অসন্তোষ হতে পারবে না।অথচ আমাদের দেশের এক শ্রেণির শ্রমিক কারখানা ভাংচুর করছে, মালিকদের ঘেরাও করছে।

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, আগামী সময়ে বেকার সমস্যা প্রকট হবে। এফডিআই আকৃষ্ট করতে বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এসেছে। সময় নষ্ট না করে এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।  ভালো ভালো কথা হচ্ছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না, এমন যেন না হয়।

সালমান এফ রহমান বলেন,বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকলে ভালো হতো। বিদেশিদের  এখানে না আসার অন্যতম কারণ হচ্ছে মুদ্রা বিনিময় হারের বৈষম্যের সমস্যা। এটা একটা বড় সমস্যা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থাকলে ভালো হতো। মানসিকতার বদল ঘটিয়ে আবং একটা টাস্কফোর্স গঠন করে সমস্যাগুলো দূর করার পরামর্শ দেন তিনি। 

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, যেটুকু পারবো সেটুকুই বলতে হবে। বিনিয়োগকারীদের পরিষ্কার কাগজ দেখাতে হবে যে আমরা সুবিধা দেব। কাজ করতে এসে যখন তারা দেখবে যে একদিনের কাজ এক মাসেও হয় না। তখন তারা নেতিবাচক চিত্র নিয়ে ফিরে যায়। আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিসের (ওএসএস) কথা বলছি, কিন্তু তারা এসে দেখছে ওএসএস নেই। ঈদের পরেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি সাংসদ শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, স্থানীয় শিল্প মালিকেরা হয়রানিমুক্তভাবে কাজ করতে না পারলে  বিদেশিরা আসতে চাইবেন না।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) পবন চৌধুরী বলেন, শুল্ক-করকে শুধু রাজস্ব আহরণের উৎস হিসেবে না দেখে বিনিয়োগের উপায় হিসেবেও দেখতে হবে। দরকার এখন স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে বড় ধরনের একটা ছাতি। 

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম বলেন,দরকার সমন্বিত প্রয়াস। ব্যবসা সূচকে এরই মধ্যে আরও এগোনো যেত। কভিড কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম বলেন, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে যেন এনবিআরের সম্মতি নেওয়া হয়। নইলে পরে সমস্যা হয়। স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার কথা ভুলে গেলেও চলবে না।

এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, করকাঠামো সংস্কার করতে হবে। প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে করপোরেট কর কমাতে হবে।

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, চ্যালেঞ্জ অনেক। তবুও সম্ভাবনার খাতগুলো চিহ্নিত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ অবশ্যই চাই। স্থানীয় শিল্পও বিপদে আছে।