মোদির '২০ লাখি প্যাকেজ': ফাঁকি, চালাকি না মুশকিল আসানের গল্প

ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ
ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ

করোনাকালে বিপর্যস্ত ভারতীয় অর্থনীতির প্রায় ভেঙে যাওয়া মাজা সোজা করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘২০ লাখি প্যাকেজ’ নিয়ে কত হাসি, কত ঠাট্টা, কতই না তামাশা ও সমালোচনা। বিরোধীরা তো বটেই, অর্থনীতি বিশারদেরাও সরাসরি বলছেন, দুধে জল মেশানো নয়, এটা হলো জলে কিঞ্চিৎ দুধ ঢালার কাহিনি।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লড়াইয়ে নামার পর, সেই ছয় বছর আগে, নরেন্দ্র মোদির সেরা প্রতিশ্রুতি ছিল বছরে এক কোটি চাকরি দেওয়ার। প্রথম পাঁচ বছর শেষ হওয়ার আগে দেখা গেল, অর্থনীতি গাড্ডায় পড়ার দরুন নতুন চাকরি তো দূরের কথা, ঘরে ঘরে বেকারের সংখ্যা গেছে বেড়ে! দ্বিতীয় যে প্রতিশ্রুতি আম আদমি বেদবাক্যের মতো বিশ্বাস করতে ভালোবেসেছিল, তা কালোটাকা উদ্ধার করে সব মানুষের ব্যাংক খাতায় ১৫ লাখ করে জমা দেওয়ার। এ কথাও বোঝানো হয়েছিল, নোট বাতিলের মধ্য দিয়ে সব কালোটাকা সাদা হয়ে যাবে। সন্ত্রাসবাদ বন্ধ হবে। অথচ হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে দেশকে নিশ্চিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া মোদির অর্থনৈতিক সাফল্য খুঁজতে সম্ভবত ফেলু মিত্তিরদের নিযুক্তি প্রয়োজন।

দেশের জন্য ২০ লাখি এই দাওয়াইয়ের অনেক আগেই বিহারের মন জিততে মোদি সোয়া লাখ কোটির প্যাকেজের কথা জানিয়েছিলেন। কাশ্মীরিদেরও ৮০ হাজার কোটির খোঁয়াব দেখিয়েছিলেন। এবার করোনার ছোবল থেকে বাঁচতে প্রধানমন্ত্রী ২০ লাখি ‘স্টিম্যুলাস প্যাকেজ’ ঘোষণা করলেন বেশ নাটকীয়ভাবেই। শুধু ২০ লাখ রুপিই নয়, সেটা যে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের ১০ শতাংশ, প্রধানমন্ত্রী সে কথাও মনে করিয়ে দেন। বিস্তারে না গিয়ে বলেন, কোন খাতে খরচের কত বরাদ্দ, অর্থমন্ত্রী পরে সেই ব্যাখ্যা দেবেন। ঘোষণা হয়েছে কি হয়নি, দেশের নিউজ চ্যানেলগুলোয় শুরু হয়ে যায় ভজনার প্রতিযোগিতা। ইদানীং ভারতীয় মাধ্যমে বিরুদ্ধ স্বর শোনাই প্রায় যায় না। গেলেও কালেভদ্রে এবং সংক্ষিপ্ত আকারে। ফলে পরের দিন জানাজানি হয়, কংগ্রেস নেতা সাবেক কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরমের মন্তব্য, ‘প্রধানমন্ত্রী শুধু হেডলাইন দিয়েছেন। বাকি সব পৃষ্ঠা সাদা। অর্থমন্ত্রী সাদা খাতা ভর্তি করুন। এরপর দেখব অর্থনীতিকে চাঙা করতে বাড়তি কত টাকা সরকার খরচ করবে।’

অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ টানা পাঁচ দিন ধরে অতঃপর যে ব্যাখ্যা দেন, তা হয়ে দাঁড়ায় অকাল বাজেটের অকাল ভাষণ! টানা পাঁচ দিন ধরে তিনি ২০ লাখের হিসাব দাখিল করলেন, অর্থনীতিবিদেরাও বাজেট পেপার মেলে ধরে মেলাতে শুরু করলেন, কত টাকা কোষাগারের বাড়তি চাপ, কতটাই বা চলমান প্রকল্প যেগুলোর বরাদ্দ ইতিমধ্যেই বাজেটে ধরা রয়েছে। চলতি আর্থিক বছরে বাজেট ঘোষণায় সরকারের খরচের প্রস্তাব ছিল ৩০ লাখ ৪২ হাজার ২৩০ কোটি রুপি। সরকার আয়ের আশা করছিল ২২ লাখ ৪৫ হাজার ৮৯৩ কোটির। ফারাক ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটির মতো। এই টাকা সরকারকে ঋণ করতে হতো। কিন্তু সরকার ঋণের বহর বাড়িয়ে ১২ লাখ কোটি স্থির করেছে। অর্থাৎ মনে করা হচ্ছে, করোনা পরিস্থিতিতে কম আয় এবং বাড়তি ব্যয়ের ফারাক ঘোচাতে সরকারের বাড়তি খরচ হবে ওই ৪ লাখ ২০ হাজার কোটির ঋণ।

কিন্তু সেটাও সম্ভব কি না, সেই প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। কেননা সরকারের আয় প্রায় নেই বললেই চলে। উল্টে করোনা বাবদ খরচের বহর বেড়ে চলেছে লাগামছাড়া। স্বরাজ ইন্ডিয়া পার্টির নেতা যোগেন্দ্র যাদব এই পরিস্থিতিতে বাজেট ধরে ধরে টাকা-আনা-পাইয়ের এক হিসাব দাখিল করেছেন। তাতে তাঁর দাবি, ২০ লাখি প্যাকেজের (নির্মলার হিসেবে মোট প্যাকেজ অবশ্য ২০ লাখ ৯৭ হাজার ৫৩ কোটি রুপির) দাবির মধ্যে সরকারের বাড়তি খরচ মাত্র ১ লাখ ৭৮ হাজার ৮০০ কোটি রুপি! যা কিনা মোট জাতীয় আয়ের (জিডিপি) ১ শতাংশের মতো!
মজার বিষয়, সরকারের বাড়তি খরচ জিডিপির মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ বলে যে দাবি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞেরা পেশ করেছেন, অর্থমন্ত্রী অথবা সরকারের অন্য কেউ তা অসত্য প্রতিপন্নে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। বরং নির্মলা সীতারমণ সমালোচনার অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, দেশের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য ফেরাতে প্রয়োজনীয় যেসব সংস্কার এত দিন করা যায়নি, করোনাকালে সেটাই তাঁরা করতে চলেছেন। প্রতিটি পদক্ষেপই দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার স্বার্থে।

এখানে কয়েকটা প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, গত ছয় বছরে এসব সংস্কারে সরকার কেন হাত দেয়নি? সংসদে বিরোধীরা হীনবল। যেভাবে বিতর্কিত সব সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক কৌশলে সরকার সংসদের উভয় কক্ষে পাস করিয়েছে, সেভাবেই এসব সংস্কার করানো যেত! দ্বিতীয়ত, এই সংকটকালে সংস্কারে হাত না দিয়ে সংকট কেটে যাওয়ার পরেই তো তা করা যেত! কিন্তু সরকার অপেক্ষা করল না কেন? তৃতীয়ত, সংস্কারের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারীকরণ। বিশেষ করে বিমানবন্দর, কয়লাখনি ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন সংস্থার। বেসরকারীকরণে কর্মীসংখ্যা সব সময়েই কমে থাকে। অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থায় সরকার কেন সেই ঝুঁকি নিতে চাইছে? চতুর্থত এবং সবচেয়ে মোক্ষম প্রশ্ন, বিশ্বব্যাপী মন্দায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ঠিকঠাক দাম সরকার পাবে না। তা হলে লোকসানে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচায় সরকারের এত আগ্রহ কেন? তা হলে কি পছন্দের ও কাছের শিল্পপতিদের সাহায্য করাই সরকারের মূল উদ্দেশ্য? এবং সে জন্য এটাই শ্রেষ্ঠ সময়, যেহেতু সবাই করোনা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত? প্রশ্নগুলো উঠছে, এই ঘোর মন্দায় বেসরকারীকরণের সিদ্ধান্ত নিতান্তই বিস্ময়কর বলে!

করোনা জাত-ধর্ম-বর্ণ না মানলেও তা যে গরিবকেই প্রাণে ও ভাতে বেশি মারছে—এই সত্য বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সারা ভারতে লকডাউনের সিদ্ধান্ত কতজন প্রভাবশালীকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে ও কত কোটি মৌসুমি বা পরিযায়ী শ্রমিককে পাগল করে তুলেছে, সেই হিসাবই এই সত্য প্রমাণে যথেষ্ট। গরিব ও প্রান্তিক কৃষক, কৃষি ও শিল্পশ্রমিক, শহুরে ও গ্রামীণ মধ্য-নিম্নবিত্ত মানুষের দিবারাত্রির কাব্য নিত্য দিন দেখিয়ে দিচ্ছে এই অসুখের চরিত্র ঠিক কী রকম। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন ও বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ চাহিদা সৃষ্টিতে গরিবের হাতে টাকা দেওয়ার যে সুপারিশ বারবার করে এসেছেন, এই ২০ লাখি প্যাকেজে তার কোনো উল্লেখই নেই। শুধু পঞ্চম দিনের সংবাদ সম্মেলনে নির্মলা সীতারমণ জানান, ১০০ দিনের কাজে সরকার বাড়তি ৪০ হাজার কোটি রুপি খরচ করবে।

অথচ কংগ্রেস আমলে গৃহীত এই ১০০ দিনের কাজকে কটাক্ষ করে ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ভরা লোকসভায় প্রধানমন্ত্রী মোদি কংগ্রেসের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘এই প্রকল্প আপনাদের ব্যর্থতার জ্বলন্ত প্রতীক। স্বাধীনতার ৬০ বছর পরেও আপনারা মানুষকে দিয়ে গর্ত খোঁড়াচ্ছেন! এই ব্যর্থতার ঢোল আমি পেটাতেই থাকব।’

গরিবদের ব্যাংক খাতায় সাড়ে সাত হাজার করে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব কংগ্রেস দিয়েছিল। দলীয় হিসেবে এ জন্য বাড়তি খরচ হতো মাত্র ৬৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু তাতে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি হতো। চাহিদা বাড়ার অর্থ জোগান বৃদ্ধি। উৎপাদন শিল্পের ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হতো ওখান থেকেই।

কিন্তু মোদি সরকার হাঁটল ঋণের রাস্তায়। ক্ষুদ্র-ছোট-মাঝারি ও বড় শিল্পপতিদের জন্য সুলভে ঋণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদেরাই প্রশ্ন তুলেছেন, চাহিদা না থাকলে ঋণ নিয়ে হবেটা কী?

২০ লাখি প্যাকেজ দুধে জল না জলে দুধ? এরই পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এই প্রশ্ন, ফাঁকি দিতে গিয়ে ফাঁদে আসলে পড়ছেটা কে? উত্তর ক্রমশ প্রকাশ্য।