খায়রুলের অনাস্থা কাটাতে পারবে তো শিবলী কমিশন?

দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার নবগঠিত কমিশনের যাত্রা। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর আজ রোববার প্রথম লেনদেন হয় শেয়ারবাজারে।

টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকার পর শুরু হওয়া লেনদেনের প্রথম দিনে দুই বাজার মিলিয়ে লেনদেন হয়েছে মাত্র ১৪৬ কোটি টাকার। তার মানে নতুন কমিশনের নেতৃত্বে ১৫০ কোটি টাকার কম লেনদেন দিয়ে শেয়ারবাজার পুনরায় সচল হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলামের নেতৃত্বে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুনর্গঠিত হয় গত ২০ মে। ওই দিন নতুন দুই কমিশনার যোগ দেওয়ার মাধ্যমে কমিশনের কোরাম সংকট দূর হয়। তার আগে ১৭ মে নতুন চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেন।

এর আগে ১৪ মে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর সামনে চরম আস্থাহীন ও বন্ধ এক শেয়ারবাজার রেখে বিদায় নেন বিএসইসির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন। আর এপ্রিলের মাঝামাঝি ও মে মাসের শুরুতে বিদায় নেন তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিশনের দুই কমিশনার স্বপন কুমার বালা ও হেলালউদ্দিন নিজামী।


টানা ৯ বছর দায়িত্ব পালন শেষে এম খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচকটি ৪ হাজার পয়েন্টে রেখে বিদায় নেন। যদিও ২০১০ সালের ধসের পর খায়রুল হোসেন যখন বিএসইসির নেতৃত্ব নেন, ডিএসইর তখনকার প্রধান সূচকটি ছিল প্রায় ৬ হাজার পয়েন্টের ঘরে। ৯ বছরে শতাধিক কোম্পানি বাজারে আনার পরও সূচকের উন্নতি তো হয়নি বরং চরম অবনতি হয়েছে। বাজারের পতন থামাতে দিনের পর দিন খায়রুল কমিশনের বিরুদ্ধে মতিঝিলে স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিক্ষোভ করেন বিনিয়োগকারীরা। তার সময়ে নিঃস্ব হয়ে বাজার ছেড়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী।
মানহীন কোম্পানি বাজারে আনার জন্য তীব্রভাবে সমালোচিত খায়রুল কমিশন। তাঁর সময়ে বাজারে আসা কোম্পানিগুলোর মানের পাশাপাশি সেসব কোম্পানি কীভাবে বাজারে এসেছে, তা নিয়ে শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে রয়েছে নানা প্রশ্ন ও অভিযোগ। বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা নেমে আসে একেবারে শূন্যে। যে কারণে বারবার বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে। ব্যাংকের মাধ্যমে শেয়ার কিনে বাজারকে টেনে তোলার চেষ্টা করা হয় বারংবার। এ জন্য দেওয়া হয় নানা সুবিধা ও আইনি ছাড়। তাতেও সুফল মেলেনি। কারণ, সুবিধা পেয়েও আস্থাহীন, সুশাসনহীন বাজারে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসেনি ব্যাংকগুলো।

তাই খায়রুল কমিশনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিশ্রেণি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের তৈরি হওয়া অনাস্থা কাটিয়ে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ এখন তারই উত্তরসূরি শিবলী রুবাইয়াতের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সামনে। খায়রুল কমিশনের কাছ থেকে অপ্রাপ্তির কারণে নতুন কমিশনের ওপর বিনিয়োগকারীদের প্রত্যাশাও অনেক।

আস্থাহীন বাজারের পতন ঠেকাতে খায়রুল কমিশনের সময়ই শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর (ফ্লোর প্রাইস) বেঁধে দেওয়া হয়। সূচক নেমে আসে তলানিতে। এমনকি তাঁর সময়েই করোনার কারণে দীর্ঘ বন্ধের কবলে পড়ে শেয়ারবাজার।
বিশ্বের প্রায় সব দেশে করোনা হানা দিলেও কোনো দেশেরই শেয়ারবাজার এত দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল না। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম একমাত্র বাংলাদেশ। বাজারের অবস্থা নড়বড়ে থাকায় মেয়াদের শেষ সময়ে এসে তাই লেনদেন চালুরও কোনো উদ্যোগ নেয়নি খায়রুল কমিশন।

করোনাকালে পুনর্গঠিত বিএসইসি বন্ধ শেয়ারবাজারে লেনদেন চালু করেছে। এখন বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তটি নিতে হবে তাদের দ্রুতই। কারণ, সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বেঁধে দিয়ে সূচকের পতন আটকে দেওয়া কখনোই বাজারের স্বাভাবিক ধারা বা চিত্র হতে পারে না। আবার এ ধরনের বাজারে খুব বেশি শেয়ারের কেনাবেচাও করা যায় না। তাই বাজারের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে, ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক লেনদেনপ্রক্রিয়া। দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে সেটি যত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হবে, ততই বাজারের জন্য মঙ্গল।

এ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে কারসাজির ঘটনা ঘটলে তার সঙ্গে জড়িতদের বিচারও নিশ্চিত করতে হবে। বন্ধ করতে হবে নানামুখী হস্তক্ষেপ।
এদিকে লেনদেন শুরু হলেও করোনা-ভীতির কারণে আজ ব্রোকারেজ হাউসগুলোতে বিনিয়োগকারীর উপস্থিতি একেবারে ছিল না বললেই চলে। ঘরে বসেই অনলাইন ও টেলিফোনে আদেশ দিয়ে শেয়ার কেনাবেচায় অংশ নেন বিনিয়োগকারীরা। তবে সেই সংখ্যাও ছিল কম। এ কারণে দুই বাজারে লেনদেন খুব বেশি হয়নি। এ ছাড়া স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা কম লেনদেন হয়েছে বাজারে। এটিও লেনদেন কমার আরেক কারণ।

দুই স্টক এক্সচেঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে গতকাল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে প্রায় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কম ব্রোকারেজ হাউস লেনদেনে অংশ নিয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে গড়ে সিএসইর সদস্যভুক্ত ১১০টি ব্রোকারেজ হাউস লেনদেনে অংশ নেয়। সেখানে গতকাল অংশ নিয়েছে ৯০টি ব্রোকারেজ হাউস। সর্বশেষ ২৫ মার্চও ১০৩টি ব্রোকারেজ হাউস লেনদেন করেছিল। তবে ডিএসইতে স্বাভাবিক সময়ের মতোই প্রায় সব কটি ব্রোকারেজ হাউস লেনদেনে অংশ নিয়েছে।
চট্টগ্রামে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমসংখ্যক ব্রোকারেজ হাউস লেনদেনে অংশ নেওয়ায় সেখানকার বাজারে লেনদেনের পরিমাণও অস্বাভাবিক কম ছিল গতকাল। মাত্র ৩ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে চট্টগ্রামের বাজারে। অথচ সর্বশেষ ২৫ মার্চ সেখানে ১১২ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। লেনদেন অস্বাভাবিক রকমের কম হলেও সিএসইর সার্বিক সূচকটি বেড়েছে ১৪১ পয়েন্ট বা সোয়া ১ শতাংশ।

প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইতে আজ দিন শেষে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি টাকা। তবে এ বাজারের প্রধান সূচকটি এদিন অর্ধশত পয়েন্ট বা সোয়া ১ শতাংশের বেশি বেড়েছে।