দোকানপাটে বেচাকেনা বাড়েনি

রাজধানীর দোকানপাট খুললেও ক্রেতার সমাগম বিশেষ হচ্ছে না। ক্রেতাশূন্য্য বেইলি রোডের একটি মার্কেট। আজ সোমবার তোলা। ছবি: সাজিদ হোসেন
রাজধানীর দোকানপাট খুললেও ক্রেতার সমাগম বিশেষ হচ্ছে না। ক্রেতাশূন্য্য বেইলি রোডের একটি মার্কেট। আজ সোমবার তোলা। ছবি: সাজিদ হোসেন

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দিনে দিনে বাড়ছে। আক্রান্ত আর মৃত ব্যক্তির সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে গত ৩১ মে থেকে লকডাউন উঠে গেলও রাজধানীতে অতিজরুরি প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বের হচ্ছেন না। ফলে শহরের আধফাঁকা নিরিবিলি দৃশ্যপটের যেমন বদল হয়নি, তেমনি দোকানপাট খুললেও ক্রেতার সমাগম বিশেষ হচ্ছে না।

টানা দুই মাসের বেশি সময় পর ঢাকার রাজপথে যাত্রীবাহী বাস চলতে শুরু করল আজ সোমবার। এ ছাড়া শহরের দৃশ্যপটে বিশেষ কোনো পরিবর্তন নেই। বাস চলাচল শুরু হলেও আজ শহরে লোকের চলাচল বরং আগের দিনের তুলনায় কম দেখা গেছে। বিপণিবিতানগুলোতে এক অর্থে বেচাকেনাই হচ্ছে না।

আজ শান্তিনগর এলাকার কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির শাড়ির দোকান জয়া শাড়ির মালিক আলতাফ হোসেন ও রোমানা জামদানি হাউসের মালিক মো. শহীদ জানালেন, রোববার থেকে তাঁদের মার্কেট খুলেছে। আজ দুপুর পর্যন্ত একটি টাকাও বিক্রি করতে পারেননি। ঈদের আগের ১০ দিনে আলতাফ হোসেন বিক্রি করেছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকার আর শহীদের দোকানে বিক্রি হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। অথচ বরাবর ঈদের আগের ১০ দিনে জয়াতে ১২ থেকে ১৫ লাখ ও জামদানি হাউসে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা বিক্রি হয়ে থাকে। তাঁরা জানালেন, এবার ঈদে নিম্ন এবং নিম্নমধ্যবিত্তদের মার্কেটগুলোতেই বেশি বেচাকেনা হয়েছে। অন্য মার্কেটে লোকজন তেমন আসেননি। এই মার্কেটে ঘুরে দেখা গেল, প্রায় প্রতিটি দোকানই ক্রেতাশূন্য। বিক্রেতারা মাস্কে মুখ ঢেকে চুপচাপ বসে আছেন। অনেক দোকানের ঝাঁপ বন্ধ।

কর্ণফুলীর অদূরেই বেইলি রোড। এখানে শাড়ির জন্য জনপ্রিয় দোকান টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির দেখা গেল বন্ধ। পথের দুই পাশের পোশাকের দোকান ও বড় বিপণিবিতানের মধ্যেও কিছু কিছু বন্ধ। এখানেও ক্রেতার স্বল্পতা। বেইলি রোডের শাড়ির দোকান বধূয়া শাড়িঘরের মালিক মো. বাবু বললেন, রোববার কোনো বিক্রি হয়নি। আজ দুপুর পর্যন্ত ৬৫০ টাকার একটি তাঁতের শাড়ি বিক্রি করেছেন তিনি।

বেইলি রোডের বড় বিপণিবিতান নাভানা বেইলি স্টারে গিয়ে দেখা গেল, ক্রেতা সামান্যই। পুরুষদের পোশাকের দোকান জেন্টল পার্কের ব্যবস্থাপক কামরুল হাসান জানালেন, ঈদের পর ক্রেতাসমাগম একটু কমই থেকে। কিন্তু এখন আগের তুলনায় লোকজনই নেই। তিনি বললেন, বেইলি রোড, সিদ্ধেশ্বরী এসব এলাকায় উচ্চবিত্ত এবং উচ্চপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা থাকেন। তাঁরা ঈদে কেনাকাটা করতে আসেননি। ঈদের পরে তো বিশেষ দরকার না হলে কেউ কেনাকাটায় আসেন না। আর এখন করোনার সংক্রমণ বাড়ছে। ফলে শহরের অন্য এলাকার চেয়ে এই এলাকায় এবার ব্যবসা খুবই খারাপ গেছে।

মালিবাগ মোড়ের কাছেই কনকর্ড টুইন টাওয়ার শপিং কমপ্লেক্স। বিশাল এই বিপণিবিতানে আজ দুপুরে তিনটি তলা ঘুরে ৫০ জন ক্রেতাও দেখা গেল না। মেয়েদের পোশাকের দোকান এস এ ফ্যাশনের মালিক তারিক মোহাম্মদ মোস্তফা ও পুরুষদের পোশাকের দোকান পার্ক ওয়ের মালিক মাকসুদুর রহমান জানালেন, ঈদের আগে ১০ দিন মার্কেট খুলেছিলেন। কিন্তু বিক্রি বিশেষ হয়নি। তারিক অভিযোগ করলেন, মার্কেট খুলে দিলেও ক্রেতাদের কেনাকাটা করতে না যাওয়ার জন্য এবার ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছিল। পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, এই কেনাকাটা যেন জীবনের শেষ কেনাকাটা না হয়! রাজনীতিক এবং তারকাদেরও অনেকে বলেছেন, কেনাকাটা না করে সেই টাকা গরিবদের দিয়ে দিতে। একে তো করোনা নিয়ে সবার মনেই আশঙ্কা ছিল, তার ওপর এসব প্রচারণা ক্রেতাদের মনে চাপ সৃষ্টি করেছে।

রাজধানীর কর্ণফুলী গার্ডেন সিটিতে নেই ক্রেতার সমাগম। ছবি: সাজিদ হোসেন
রাজধানীর কর্ণফুলী গার্ডেন সিটিতে নেই ক্রেতার সমাগম। ছবি: সাজিদ হোসেন

ফলে তাঁরা কেনাকাটা করতে আসনেনি। এই ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছিলেন, ব্যবসায়ীদের দিকটি কেউ বিবেচনা করেননি। পোশাক–আশাকের ব্যবসা সারা বছর কোনোরকম টানাটানি করে চলে যায়। দুই ঈদ আর পূজাতেই এই ব্যবসার যা লাভ, তা দিয়েই দোকানমালিক ও কর্মচারীদের দিন চলে। এবার প্রতিটি মালিকের লাখ লাখ টাকার মাল দোকানে আটকে গেল। কর্মচারীরা বেতন পাননি। কীভাবে এই সংকট কাটবে, তাই নিয়ে সবাই খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। একই রকম প্রায় ক্রেতাবিহীন অবস্থা দেখা গেল শান্তিনগরের ইস্টার্ন প্লাস, মালিবাগের আয়শা শপিং কমপ্লেক্স, সিদ্ধেশ্বরীর মৌচাক, আনারকলি—এসব মার্কেটেও। এসব এলাকার মার্কেটের ব্যবাসয়ীরা সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখার সময়সীমা পরিবর্তন করে বেলা ১১টা থেকে রাত অন্তত ৯টা পর্যন্ত করার কথা বলেছেন।

বেলা তিনটার দিকে হাতিরপুল এলাকায় গিয়ে মোতালেব প্লাজায় দেখা গেল, সেলফোনের দোকানগুলোতে ক্রেতাদের কিছু উপস্থিতি আছে। এখানে কিছু কিছু বেচাকেনা চলছে। চকবাজার থেকে ফাহিম হোসেন এসেছিলেন সেলফোন কিনতে। তিনি জানালেন, তাঁর আগের ফোনটি নষ্ট হয়ে গেছে। তাই এখানে এসেছেন একটি নতুন সেট কিনতে। বেশি ঘোরাঘুরি করবেন না। এখানে অনেক দোকান আছে। ফোন কিনে সোজা আবার বাড়িতে।

ইস্টার্ন প্লাজা হাতিরপুল এলাকার অনেক পুরোনো বিপণিবিতান। পোশাকের দোকান অঙ্গনার বিক্রয় প্রতিনিধি আবদুল কাদের জানালেন, আজই প্রথম এই মার্কেট খুলেছে। বেচাকেনা তেমন শুরু হয়নি, তবে লোকজন কিছু কিছু আসছেন।

হাতিরপুল মোড় থেকে পুরো সোনাগাঁ রোডের দুই পাশে টাইলস আর স্যানিটারি ফিটিংসের ৩০০–র মতো দোকান। ৩০ মে থেকে এসব দোকানও খুলেছে। তবে বেচাকেনা ভালো নয়। হ্যাপি হোম নামের দোকানটি বেশ বড়। বিকেলে দোকানে ঢুকে বিক্রিবাট্টার কথা জানতে চাইলে বিক্রয় প্রতিনিধি রুহুল আমিন জানালেন, এই তিন দিনে কেবল পাঁচ হাজার টাকার একটি বেসিন বিক্রি করেছেন। অথচ স্বাভাবিক সময় এসব বড় দোকানে প্রতিদিন অন্তত এক লাখ টাকার বিক্রি হয়ে থাকে। ব্যবসার এমন মন্দা অবস্থার কথা তাঁরা কখনো ভাবতেও পারেননি।