রাজস্ব আয়ে বড় ঘাটতি, আসছে বিশাল লক্ষ্য

চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি ৬২ হাজার কোটি টাকা। বছর শেষে সংশোধিত লক্ষ্য থেকেই ঘাটতি ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। 

 শেষ পর্যন্ত ঘাটতি কতটা কমানো যাবে, সেটাই এখন প্রশ্ন। আর রাজস্ব আদায়ে এই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ঠেকানোই এখন এনবিআরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আবার আসছে নতুন বাজেট। একদিকে করোনা প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরে নতুন করারোপের চেয়ে বেশি কর ছাড় দেওয়ার চাপ, অন্যদিকে বাড়াতে হবে আদায়। এসব নিয়েই আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট তৈরি করতে হচ্ছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। 

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই অবশ্য রাজস্ব আয়ে ছিল খানিকটা ভাটার টান। এরপর দেখা দেয় করোনাভাইরাস। এতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় গত এপ্রিল মাসে যে রাজস্ব আদায় হয়েছে, তা চলতি অর্থবছরের অন্য যেকোনো মাসের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। এনবিআরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এবার বড়জোর ২ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার মতো শুল্ক-কর আদায় হতে পারে। 

 আবার আগামী অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) পুরো সময় ব্যবসা-বাণিজ্য আগের মতো স্বাভাবিক থাকবে—এমন আশা কম। তারপরও আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগামী অর্থবছরে ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে। প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। গত ১০ বছরে মাত্র একবার ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এনবিআরকে কখনোই তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয় না। বাস্তবে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায় করা সম্ভব, তা চিন্তা করা হয় না। সার্বিকভাবে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজেটের আকার ঠিক করা হয়। সেই বড় বাজেটের অর্থের জোগান দিতেই মূলত বড় লক্ষ্য দেওয়া হয় এনবিআরকে। 

করোনায় বিপর্যস্ত রাজস্ব আদায়

 মে মাসের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। গত এপ্রিলে ১৯ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল। আদায় হয়েছে মাত্র ৮ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ১ লাখ ৭৩ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে। এই সময়ে শুল্ক-কর আদায়ের লক্ষ্য ছিল ২ লাখ ৩৫ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা। ঘাটতি প্রায় ৬২ হাজার কোটি টাকা টাকা। 

 রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য নতুন ভ্যাট আইন চালু করা হয়। কিন্তু সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির কারণে সবকিছু বন্ধ থাকায় এপ্রিল মাসে অর্ধেক প্রতিষ্ঠানই রিটার্ন জমা দিতে পারেনি। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস হলো রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় জায়গা। কিন্তু সীমিত পরিসরে আমদানি চালু থাকায় গত এপ্রিল মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য তিন ভাগের এক ভাগ অর্জিত হয়েছে।

এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের সদস্য জামাল হোসেন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো খোলা রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য এনবিআরের পক্ষ থেকে নানামুখী চেষ্টা করা হচ্ছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা হলে রাজস্ব আদায়ে গতি বাড়বে। 

 চলতি অর্থবছরে এনবিআরের মূল লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় এই লক্ষ্য কমিয়ে ৩ লাখ ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সেই হিসাবে মে ও জুন মাসে এনবিআরকে ১ লাখ ২৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা আদায় করতে হবে। করোনার সময়ে এই লক্ষ্য অর্জন প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। 

 এই অসম্ভব বিষয়টি ইতিমধ্যে অর্থসচিবকে জানিয়ে দিয়েছেন এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। গত ১৪ মে দেওয়া এক চিঠিতে তিনি আরও বলেছেন, আগামী অর্থবছরে যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, তা আদায় করাও সম্ভব হবে না। 

 এবার দেখা যাক, আগামী অর্থবছরে কোন খাতে কত লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। সার্বিকভাবে এনবিআরকে লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে ভ্যাটে। এই খাতে ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা আদায় করার লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া আয়করে ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা এবং শুল্ক খাতে ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকার লক্ষ্য থাকছে।

ভ্যাট আইন

গত জুলাই মাস থেকে নতুন ভ্যাট আইন চালু হয়। উদ্দেশ্য, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি। মাঠপর্যায়ে নতুন আইনের নানা জটিলতার কারণে প্রথম দুই মাস ভ্যাট আদায়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। আর প্রথম ছয় মাসে ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয় মাত্র ৭ শতাংশ। অন্য বছর এই সময়ে ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের বেশি থাকে। 

 আইনটি বাস্তবায়নের শুরু থেকেই মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা শুরু হয়। ব্যবসায়ীরা নতুন আইনে অভ্যস্ত হতে পারেননি। এবারই প্রথমবারের মতো কিছু বাদ দিয়ে আমদানি পর্যায়ে সব ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর আগাম ভ্যাট বসানো হয়। পরে আবার প্রজ্ঞাপন দিয়ে আগাম ভ্যাট ছাড়ের পণ্যের তালিকা বাড়ানো হয়। 

 আগাম কর ফেরত দেওয়া নিয়েও তৈরি হয় নানা জটিলতা। আগাম কর ফেরত দেওয়ার কোনো আলাদা তহবিল তৈরি করা হয়নি। নতুন আইন চালুর প্রায় ৬ মাস পর বলা হয়, এনবিআরের পরিচালন খরচ থেকে আগাম কর ফেরত দেওয়া যাবে। 

 নতুন ভ্যাট আইনে বেচাকেনার হিসাব রাখার জন্য ২৪ ধরনের ব্যবসায় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি বা ইএফডি মেশিন ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হয়। এতে ছোট ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েন। তাঁদের দাবি, স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে হিসাব করতে হলে আলাদা লোকবল লাগবে। এ ছাড়া গত জুলাই মাসে কেনা দামে ছোট ব্যবসায়ীদের ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা দেওয়া সম্ভব হয়নি। চলতি জুন মাস থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ইএফডি মেশিনের ব্যবহার শুরু হবে। 

 নতুন আইনে অটোমেশনকে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু একমাত্র যশোর ভ্যাট কমিশনারেট ছাড়া আর কোনো কমিশনারেটে ঘরে বসে সবার ভ্যাট রিটার্ন জমা নিশ্চিত করা যায়নি। ফলে করোনার সময় নিয়মিতভাবে যেসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট রিটার্ন দেয়, তাদের অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান রিটার্ন দেয়নি।