কম সুদের ঋণ সবাই পেতে চায়

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা থেকে কম সুদে ঋণ পেতে ছোট-বড় সব ধরনের প্রতিষ্ঠানই আবেদন করেছে। আবেদনকারীদের মধ্যে উৎপাদনশীল ও সেবা উভয় খাতের প্রতিষ্ঠান আছে। খারাপ গ্রাহকদের পাশাপাশি ভালো করপোরেট গ্রাহকেরাও এই ঋণ পেতে আবেদন করছে। এভাবে গয়রহ আবেদন করার প্রধান কারণ হলো, এই ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ হলেও তাদের দিতে হবে মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ বহন করবে সরকার। বিদেশ থেকে ঋণ নিতেও এর চেয়ে বেশি খরচ পড়ে।

এদিকে ব্যাংকগুলো বলছে, ফেরত দেবে এমন গ্রাহকেরাই শুধু এ ঋণ পাবে। কারণ, সরকার সুদের অর্ধেক দিলেও এ ঋণ আদায়ের সব দায়দায়িত্ব ব্যাংকেরই থাকবে।

করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিতে সরকার ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এর অর্ধেক অর্থাৎ ১৫ হাজার কোটি টাকার জোগান দিতে একটি আবর্তনশীল পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব ব্যাংক মিলে দেবে ২৮ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিতরণ করবে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, এই ঋণের মেয়াদ হবে তিন বছর। যেসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ চলতি মূলধন-সুবিধা নিয়েছে, তার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবে এই তহবিল থেকে। তবে ক্ষতিগ্রস্তরাই কেবল এই ঋণ পাবে। ঋণখেলাপিরা এই তহবিল থেকে কোনো ঋণ পাবে না। শুধু ঋণখেলাপিই নয়, তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করেছেন, এমন ব্যবসায়ীদেরও ঋণ দেওয়া যাবে না।

ব্যাংকাররা বলছেন, করোনার কারণে যে ঋণ দেওয়া হবে, তা সহজেই আদায় করা যাবে না। এ ছাড়া গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক কমে যাচ্ছে। এ জন্য ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অতিসতর্কতা অবলম্বন করছেন বলে জানান তাঁরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই তহবিল থেকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক ৯১৪ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারবে। ইতিমধ্যে ব্যাংকটি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ওয়াটা কেমিক্যালের নামে ১৯ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করেছে। ব্যাংকটিতে ঋণ পেতে আবেদন করেছে যমুনা গ্রুপ, থারমেক্স, একমি, ডায়মন্ড সিমেন্ট, পিএইচপি গ্রুপ, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, সিটি, নিটল নিলয় গ্রুপসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান।

জানতে চাইলে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহম্মদ শামস-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কম সুদের ঋণ, তাই সবাই আবেদন করবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা বেছে বেছে রপ্তানিমুখী ভালো প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেব, যাতে টাকাটা ফেরত আসে।’

দি সিটি ব্যাংক ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারবে। ব্যাংকটিতে ঋণ পেতে আবেদন করেছে বিআরবি কেবল, টিভিএস অটো, সিটি গ্রুপ, মোবাইল অপারেটর রবি, বিএসআরএম স্টিল, কেএসআরএম স্টিল, শাহ সিমেন্ট, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, প্রাণ-আরএফএল, এসিআইসহ আরও অনেকে। ইতিমধ্যে ব্যাংকটি বেশ কিছু ঋণ মঞ্জুরও করে তা চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে পাঠিয়েছে।

এ ব্যাপারে দি সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশির ভাগ গ্রাহকই ঋণ পেতে আবেদন করেছে। আমরা যাচাই–বাছাই করছি, এরপরই অনুমোদন হচ্ছে।’

৯১৪ কোটি টাকা ঋণ দেবে এক্সিম ব্যাংক। ব্যাংকটির গ্রাহকদের মধ্যে প্রায় ৩৫০টি পোশাক কারখানা রয়েছে। তাদের বেশির ভাগই ঋণ পেতে আবেদন করেছে। আগামী সপ্তাহে এই ব্যাংক পর্ষদ সভা করে ঋণ অনুমোদন দিতে শুরু করবে বলে জানা গেছে।

প্রাইম ব্যাংক ঋণ দিতে পারবে ৯১২ কোটি টাকা। ঋণ পেতে ব্যাংকটিতে আবেদন করেছে বিএসআরএম স্টিল, কেএসআরএম স্টিল, স্কয়ার টয়েলট্রিজ, কেডিএস গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপসহ অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান।
রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক একাই ১ হাজার ৬২২ কোটি টাকা ঋণ দেবে। ব্যাংকটি ইতিমধ্যে উড়োজাহাজ পরিচালনাকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের জন্য চলতি মূলধন হিসেবে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে। ঋণ পেতে আরও আবেদন করেছে থারমেক্স, গুলশান স্পিনিংসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

এ ছাড়া বেসরকারি ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালকে শিগগিরই সাড়ে চার কোটি টাকা ঋণ দিতে যাচ্ছে আরেক সরকারি ব্যাংক রূপালী। ব্যাংকটি গ্রিন প্লানেট রিসোর্টকে ৫ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে। এই ব্যাংকে আরও আবেদন করেছে অবন্তী গ্রুপ, নোমান গ্রুপ, থারমেক্সসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ। ব্যাংকটি ঋণ দেবে ৭৮৭ কোটি টাকা।

জনতা ব্যাংকের ঋণ পেতে আবেদন করেছে যমুনা গ্রুপ। বেক্সিমকো গ্রুপও আবেদন করবে বলে জানান ব্যাংকটির এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সবাই যোগাযোগ করছেন। তাঁদের বেশির ভাগই আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ৩০ হাজার কোটি টাকার মধ্যে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা ঋণ দেবে ইসলামী ব্যাংক। অন্য বড় ঋণদাতাদের মধ্যে সোনালী ব্যাংক ১ হাজার ৬২২ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক ১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা ও ডাচ-বাংলা ব্যাংক ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা দেবে।

এ ছাড়া অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে দি সিটি ১ হাজার ২৩ কোটি, এক্সিম ৯৯৪ কোটি, ইস্টার্ণ ৯৮৫ কোটি, অগ্রণী ৯১৪ কোটি, প্রাইম ৯১২ কোটি, ব্যাংক এশিয়া ৮১৯ কোটি, রূপালী ৭৮৭ কোটি, মার্কেন্টাইল ৭৭৪ কোটি, সাউথইস্ট ৭৬৬ কোটি ও ঢাকা ব্যাংক ৭৫৮ কোটি টাকা ঋণ দেবে।

বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডকে ৭২৪ কোটি টাকা ও কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনকে ৩৩৪ কোটি টাকার ঋণ বিতরণের সীমা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।