পাঁচ প্রকল্পের 'রাজকপাল'

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে পাঁচটি প্রকল্পে ৩৮ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট এডিপির প্রায় ১৯ শতাংশ।

আগামী ২০২০–২১ অর্থবছরেও উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা খরচে বড় প্রকল্পগুলোই সরকারের অগ্রাধিকার পাবে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র পাঁচটি প্রকল্পেই খরচ হবে পুরো এডিপির ১৯ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ। টাকার অঙ্কে আগামী অর্থবছরে ৩৮ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা খরচ করা হবে ওই পাঁচ প্রকল্পে, যা এডিপির পাঁচ ভাগের এক ভাগ।

যে পাঁচ প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় হবে সেগুলো হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচি, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি, পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল প্রকল্প। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বরাদ্দ আছে রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে। এ অবস্থায় রূপপুরে এত বরাদ্দ রাখা যৌক্তিক হয়নি। বরাদ্দ কমিয়ে তা করোনা মোকাবিলার কাজে লাগানো যেত।

আগামী অর্থবছরের এডিপির আকার ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। ১ হাজার ৫৮৪টি প্রকল্পে এই টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘রাজকপাল’ পাঁচ প্রকল্পের। এ পাঁচ প্রকল্পের মধ্যে দুটি স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের প্রকল্প, বাকি তিনটি অবকাঠামো প্রকল্প। এ ছাড়া নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে এক শর বেশি প্রকল্প বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।

জানতে চাইলে বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এম ফওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে সক্ষমতা আছে, সেই বিদ্যুতেরও চাহিদা নেই। করোনার কারণে ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং নতুন বিনিয়োগ নিয়ে শঙ্কা আছে। তাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে এত বরাদ্দের বিষয়টি বিশেষভাবে পর্যালোচনা করা উচিত।

ফওজুল কবির খানের মতে, সরকারের মধ্যে মেগা প্রকল্প নেওয়ার প্রবণতা আছে। মেগা প্রকল্পে বছর–বছর বিপুল অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু মেগা প্রকল্প সঠিক সময়ে শেষ করার মতো দক্ষতা নেই। তাই মেয়াদ ও খরচ দুটোই বাড়ে। ফলে প্রকল্পের অর্থনৈতিক সুবিধাও কমে যায়। তাই হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেগা প্রকল্পে নেওয়া উচিত কি না, তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা হওয়া উচিত।

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

কোন প্রকল্পে কত বরাদ্দ

২০১৬ সালে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পে আগামী বছর ১৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি ২০১৯–২০ অর্থবছরের বাজেটে এই প্রকল্পে ১৪ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। ২০২৫ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা আছে। গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ২৩ শতাংশের মতো টাকা খরচ হয়েছে। আগামী বছরে এই প্রকল্পে যত টাকা খরচের পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা পদ্মা সেতু নির্মাণ খরচের অর্ধেকের চেয়েও বেশি।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচি। এটি একটি গুচ্ছ প্রকল্প। জনগণের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় মাঠপর্যায়ে নানামুখী কাজ করা হয় এ প্রকল্পের আওতায়। এই প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে ৮ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। চলতি এডিপিতে বরাদ্দ আছে ৭ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। ৪৩ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত। অথচ ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন মাত্র ২১ শতাংশ।

তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ আছে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচিতে। এতে ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মতো এই গুচ্ছ কর্মসূচিটি শুরু হয়। শেষ হবে ২০২৩ সালের জুন মাসে। সব মিলিয়ে খরচ হবে ৩৮ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ হিসাবমতে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫ শতাংশের মতো টাকা খরচ হয়েছে।দুই

চতুর্থ সর্বোচ্চ বরাদ্দ পদ্মা সেতুতে। আগামী অর্থবছরে ৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে সরকারের অন্যতম এই অগ্রাধিকার প্রকল্পটি। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা খরচ করে সেতুটি নির্মাণ করা হচ্ছে। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত প্রকল্পের ৭৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে প্রকল্পের কাজ কিছুটা শ্লথ হয়েছে। তবে চীনা প্রকৌশলীদের বেশির ভাগই ফেরত এসেছেন। চলতি অর্থবছরে ৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা কমিয়ে ৪ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। আগামী বছর জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

রাজধানীর যানজট কমাতে ২০১২ সালে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৪২ শতাংশের মতো শেষ হয়েছে। আগামী এডিপিতে এই প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। করোনার কারণে এই প্রকল্পের কাজও মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।

এ ছাড়া আগামী অর্থবছরের এডিপিতে সরকারের অগ্রাধিকার অন্য প্রকল্পগুলোতে বিশাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেমন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে ৩ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণে (থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ) ২ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা, বঙ্গবন্ধু রেলসেতু প্রকল্পে ২ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।