করোনা মোকাবিলায় কি যথেষ্ট নেপালের বাজেট

নেপালের অর্থমন্ত্রী ইয়ুবা রাজ খাতিওয়াদা
নেপালের অর্থমন্ত্রী ইয়ুবা রাজ খাতিওয়াদা

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতিগুলো যেখানে তাঁদের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমাচ্ছে সেখানে নেপালের মতো ছোট একটি দেশ বেশ উচ্চাকাঙ্ক্ষায় দেখাল তাদের নতুন বাজেটে। চলতি অর্থবছরের জন্য তারা প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছে ৭ শতাংশ। অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক আশাবাদী নেপালের অর্থমন্ত্রী বেশ ইয়ুবারাজ খাতিওয়াদা। তিনি মনে করেন, করোনা ঠেকাতে নেওয়া লকডাউন খুলে দিলে গত তিন বছরের মতো এবারও ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।

সম্প্রতি বর্তমান সরকারের অধীনে তৃতীয় বাজেট পেশ করেছে নেপাল। আর এই বাজেট প্রস্তাবের সময়েই এতটা আশাবাদী দেখা গেছে অর্থমন্ত্রীকে। এবারের বাজেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ বর্তমান সরকার এই মহামারি মোকাবিলায় কীভাবে তার সম্পদের বণ্টন করে—তা দেখতে কড়া নজর রেখেছিলেন বিশ্লেষকেরা। তাই খাতভিত্তিক বাজেট ও কোন কোন প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে তার বিশদ বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে অনেক আলোচনায়।

দ্য কাঠমান্ডু পোস্টের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এমন এক বাজেট পেশ করেছে নেপাল সরকার যেখানে করোনাসহ বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার পুরো চিত্র ফুটে ওঠেনি। যদিও ‘নেপাল এই সংকট থেকে ফিরে আসবে’ বিশ্বাসের সঙ্গে এই ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির অর্থমন্ত্রী ইয়ুবারাজ খাতিওয়াদা। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তব্যে ঘোষিত পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য আনার জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণ বাবদ ১ দশমিক ৯৩ ট্রিলিয়ন রুপি জোগাড় করার অভিপ্রায় ঘোষণা করেছেন। দুইটি বিষয়ের ওপর সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ১. অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ২. স্বাস্থ্য খাত। তবে সমস্যা হচ্ছে বিগত দুটি বাজেটের মতোই সরকার এবারও কিছু অবাস্তব কর্মসূচি এবং নীতিমালা হাতে নিয়ে। নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মটি আবার ব্যবহার করেছে। বেশ কিছু সন্দেহজনক তহবিল বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে।

বাজেটে যা রাখা হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের জন্য
নেপালের বর্তমান বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের জন্য ৬৮ বিলিয়ন রুপি বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। নতুন প্রস্তাবিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ৯০ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন রুপি করা হয়েছে। মজার বিষয় হচ্ছে, চলতি বাজেটের চেয়ে নতুন বাজেটের আকারই বেড়েছে ২০ বিলিয়ন রুপি। সরকার অনেকগুলো কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছে, তবে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য আনুপাতিকভাবে অর্থের ভারসাম্য হয়নি। আসলে স্বাস্থ্যসেবা এবং জনস্বাস্থ্যে আগের বাজেটগুলোতে যা বরাদ্দ থাকত তা কখনই যথেষ্ট ছিল না। আগের বাজেটগুলোতে এ খাতের জন্য সরকার যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার বেশির ভাগই পূরণ করেনি। যেমন: নিরাপদ মাতৃত্ব কর্মসূচি, টেলিমেডিসিন ও প্রবীণদের জন্য ওষুধ ও চিকিৎসা ভর্তুকি—এগুলো অধরায় রয়ে গেছে।

ইতিমধ্যে সংকুচিত হয়ে আসা স্বাস্থ্য সুবিধাগুলোর কথা মাথায় না রেখে স্থানীয় পর্যায়ে ২০০টি হাসপাতাল তৈরির বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে নতুন বাজেটে। খাতিওয়াদা সংক্রামক রোগের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা প্রদানের ঘোষণা করেছেন। কাঠমান্ডুতে ২৫০টি আইসিইউ শয্যাসহ একটি নতুন কেন্দ্র স্থাপিত হবে। এবং প্রতিটি প্রাদেশিক রাজধানীতে ৫০টি আইসিইউ শয্যাসহ কেন্দ্র বসানো হবে। আর এই অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোর জন্য স্বাস্থ্য বাজেট থেকে কমপক্ষে ১২ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যাবে। ফলে এই বছরে নারী স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাতা দ্বিগুণ করা, নতুন ডায়াগনস্টিক, টেলিমেডিসিন সুবিধা এবং প্রতিটি স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য ৫০০,০০০ রুপি বিশেষ বিমার মতো প্রকল্পগুলোর জন্য বাজেট বরাদ্দের খুব সামান্য অর্থই থাকবে। এ ছাড়া বর্তমান অবকাঠামোর সংস্কার এবং প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য যে বরাদ্দ প্রয়োজন তা আর জোগাড় সম্ভব হবে না।

শিক্ষা খাতে যা বরাদ্দ রেখেছে নেপাল
এবার আসা যাক শিক্ষা খাতের জন্য কতটুকু রয়েছে বরাদ্দে। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য বাজেট সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান বাজেটে এই বরাদ্দ ছিল ১৬৩ বিলিয়ন রুপি। এবার তা ১৭১ বিলিয়ন রুপি করা হয়েছে। বৈশ্বিক মান অনুযায়ী, শিক্ষার জন্য একটি দেশের জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখতে হয়। তবে আগের দুই বছরের মতো এবারও নেপালের বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ বেশি বাড়েনি। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ৭৫৫৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ পুনর্গঠন করা হয়েছে। ২০,০০০ এর বেশি সরকারি স্কুলগুলোর মধ্যে মাত্র ৮ হাজারের মতো স্কুলে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক অবকাঠামো রয়েছে। অথচ সেসব দিকে নজর না দিয়ে এই সামান্য বরাদ্দ বাড়িয়েই সরকার নিয়েছে নানা পরিকল্পনা। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষক সংখ্যার ব্যবধান পূরণসহ ১ হাজার নতুন কম্পিউটার ও বিজ্ঞান পরীক্ষাগার নির্মাণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে কমিউনিটি শিক্ষাকে উৎসাহিত করা। এ ছাড়া বৃত্তি প্রদানসহ আরও নানা পরিকল্পনা করেছে সরকার যা এই বাজেটে কীভাবে সম্ভব তা বলা হয়নি। এমনকি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির বিষয়েও কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি।

বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করার মতো কী আছে
বাজেটে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা যায় এমন কোনো ঘোষণা আসেনি। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা, স্টার্ট আপ, এসবের জন্য বাজেটে সরকারের বিনিয়োগের পরিকল্পনা মাত্র ৫০ কোটি রুপি। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই তহবিল কোনো ইকুটি বিনিয়োগ হিসেবে ব্যয় হবে না বরং ২ শতাংশ সুদে নমনীয় ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। নতুন শিল্পাঞ্চলের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ২ বিলিয়ন রুপি। তবে এটি বর্তমান শিল্পগুলোকে খুব বেশি উৎসাহিত করতে পারেনি কারণ বর্তমান মন্দায় টিকে থাকায় মুশকিল হয়ে পড়েছে বেশির ভাগ কারখানাগুলোর।

যে খাতগুলোর জন্য আশা আছে বাজেট
যদিও কিছু হতাশাজনক ঘোষণা এসেছে। তবে সরকার অন্তত কৃষি খাত ও বর্তমান অবকাঠামোগত প্রকল্পগুলোকে উৎসাহিত করার বিষয়ে দৃষ্টি রেখেছে—যার প্রশংসা করতেই হয়। আঞ্চলিক সংরক্ষণাগারগুলোর পুনর্বনায়ন ও খাদ্য সংকট মোকাবিলায়ও নজর দিয়েছে সরকার। যদি এর সমস্ত নীতি এবং পরিকল্পনাগুলি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা হয় তবে এটিকে ভালো উন্নয়নই বলা যায়।

নেপালের বাজেট বাস্তবায়নের মূল সমস্যা
নেপালের বাজেট বাস্তবায়নের মূল সমস্যা হলো বাজেটের বরাদ্দ ছাড়ে সমস্যা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথমার্ধে ফেডারেল সরকার এবং বেশির ভাগ প্রাদেশিক সরকার মূলধন বাজেটের বরাদ্দের ২০ শতাংশ অর্থও ব্যয় করতে পারেনি। সেই সঙ্গে বছরের পর বছর, ধারাবাহিকভাবে সব সরকারই সময় মতো কার্যকর নীতি প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাজেটের বিষয়ে নেপাল কংগ্রেসের সাবেক অর্থমন্ত্রী রামশরণ মাহাত বলেছেন, ‘আগামী অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী। কারণ ভাইরাসের প্রভাব আগামী অর্থবছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’ মাহাত মনে করেন, এ বাজেট কেবল প্রত্যাশা আর আকাঙ্ক্ষার বুলি। তিনি বলেন, ‘পুরো বাজেটে বলা হয়েছে, আমরা এটা করছি, আমরা ওটা করছি। এ কোনো বাজেট হতে পারে না।’

আসলে ভাইরাস মোকাবিলায় এই বাজেট কার্যকর হবে—এমনটা ভাবতে পারছেন না অর্থনীতিবিদেরা। তারা বলছেন, লকডাউন আরও বাড়তে থাকায় সব স্থবির হয়ে থাকবে আরও কিছুদিন। আর যা নেপালের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, হাজার হাজার প্রবাসী বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রেক্ষিতে স্বদেশে ফিরে আসবেন, এই বিষয়টি সহ বেশ কয়েকটি সংকটের বিষয়ে বাজেটে উল্লেখই হয়নি। দেশটির ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিশনের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শংকর শর্মা বলেন, বাজেটে স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে অথচ যে হাজার হাজার প্রবাসী ফিরে আসছেন তাদের কী হবে কিছুই বলা হয়নি।