মুনাফা নয়, জোর টিকে থাকায়

>করপোরেটে কেমন যাচ্ছে করোনাকাল, চ্যালেঞ্জ কী কী, আগামী দিনগুলোতে চাহিদার পূর্বাভাস কী, ‘নেক্সট নরমালে’ কী কী কৌশল নিয়ে এগোতে হবে—এসব নিয়ে বলেছেন শীর্ষস্থানীয় করপোরেটের কয়েকজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও

করপোরেটে এমন দিন আর আসেনি। বাজার বড় হচ্ছিল, বিক্রি বাড়ছিল। বছর বছর নতুন বিনিয়োগ আর উৎপাদন ক্ষমতার সম্প্রসারণ ছিল শিল্পগোষ্ঠীগুলোর জন্য সাধারণ ঘটনা।

নজর ছিল প্রতিযোগীর দিকে, তার তুলনায় নিজের বিক্রি কতটুকু বাড়ল? প্রতি প্রান্তিক শেষে চলত চুলচেরা বিশ্লেষণ। সব কৌশলের মূল লক্ষ্য ছিল বাজারে হিস্যা বা মার্কেট শেয়ার কীভাবে দখল করা যায়, কীভাবে বিক্রি আরও বাড়ানো যায়।

করোনা সবকিছু পাল্টে দিয়েছে। এখন আর অন্যের ‘এক্সেল শিটের’ দিকে তাকানোর সময় নেই। বরং দেখতে হচ্ছে নিজেদের বিক্রির পরিমাণ কতটা কমছে। করোনা এড়িয়ে কীভাবে উৎপাদন ও সরবরাহ সচল রাখা যায়, কীভাবে কর্মীদের উজ্জীবিত রাখা যায়—এটাই এখনকার চিন্তা।

‘বেঁচে থাকাটাই এ বছরের মুনাফা’, আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা চীনা উদ্যোক্তা জ্যাক মার নাম দিয়ে এমন একটি উদ্ধৃতি অনলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও জ্যাক মা এ কথা বলেননি (ভারতের পত্রিকা ইন্ডিয়া টুডের ‘ফ্যাক্ট চেক টিম’ এটি নিশ্চিত করেছে)। কিন্তু বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বলছেন, তাঁদের এ বছরের কৌশল আসলেই টিকে থাকা, মুনাফা নয়।

দেশের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ও নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে প্রথম আলোর আলাপ হয়। বিষয় ছিল, কেমন যাচ্ছে করোনাকাল, চ্যালেঞ্জ কী কী, আগামী দিনগুলোতে চাহিদার পূর্বাভাস কী, ‘নেক্সট বা নিউ নরমাল’ বা করোনার প্রাদুর্ভাব কমার পর নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় কী কী কৌশল নিয়ে এগোতে হবে।

 কথা বলেছেন ক্রাউন সিমেন্টের ভাইস চেয়ারম্যান আলমগীর কবির, প্রাণ-আরএফএলের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী, আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন, বার্জার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী, এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মোমেন ভূঁইয়া, বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত ও সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা।

এ ছাড়া ইউনিলিভার বাংলাদেশ প্রশ্নের লিখিত উত্তর পাঠিয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ হয়েছে, যার নির্বাহীরা নাম প্রকাশ করতে চাননি।

সবার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হলো, দেশে ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জরুরি সেবা ছাড়া বাকিদের অফিস পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যারা নিত্যপণ্য সরবরাহ ও জরুরি সেবা নিশ্চিত করতে খোলা রেখেছিল, তারা পড়ে বিপাকে। কর্মীদের রাস্তায় নামতে দেওয়া হয়নি, পরিবহন চলতে বাধা দেওয়া হয়েছে, শ্রমিকের অনেকে কারখানায় যেতে পারেননি। কিছুদিন পরেই অবশ্য চলনসই একটা ব্যবস্থা হয়।

এপ্রিল মাসের শেষ দিকে জরুরি পণ্য ও সেবার বাইরে আরও কারখানা খুলতে থাকে। কিছু কিছু বেসরকারি অফিস ৫ মে থেকে সীমিত পর্যায়ে খুলে যায়। সাধারণ ছুটি শেষ হয়েছে ৩০ মে। পরদিন পুরো দেশেই বেসরকারি অফিস খুলেছে। তবে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরেনি।

করপোরেটগুলো সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছে। কেউ কেউ কর্মীদের একটি অংশকে অফিসে আসতে বলছে, বাকিদের বাসায় থেকে কাজের সুযোগ দিয়েছে। কেউ কেউ সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে অফিসের বসার টেবিল বা ডেস্কের পুনর্বিন্যাস করেছে। ক্রেতার সঙ্গে বৈঠক, অফিসের সভা অনলাইনে। জীবাণুনাশক, মাস্ক ব্যবহার, নিয়মিত অফিস পরিষ্কার করা তো রয়েছেই। বিদেশি করপোরেটের বেশির ভাগের এখনো হোম অফিস ব্যবস্থায় রয়েছে। তারা অন্তত ১৫ জুন পর্যন্ত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

পুরো করোনাকালে ব্যবসা ঠিক রেখেছে এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডস। তারা জীবাণুনাশক, সাবান, প্রসাধন, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও বিভিন্ন নিত্যব্যবহার্য পণ্য বিপণন করে। এসবের চাহিদায় ভাটা পড়েনি। উৎপাদন, বিপণন ও সরবরাহ কীভাবে, জানতে চাইলে এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক কর্মীর সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছি। সুরক্ষা সামগ্রী সরবরাহ করেছি। কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা ও দায়িত্ব অফিসের, তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

অবশ্য সব পণ্যের চাহিদা ছিল না। তাদের জন্য পরিস্থিতি ভিন্ন। উড়োহাজাজ চলাচল কোম্পানি, হোটেল ও পর্যটন খাত বলছে, তাদের ব্যবসা এখনো বন্ধ। সিমেন্ট, ইস্পাতসহ নির্মাণসামগ্রীর কোম্পানি জানিয়েছে, বিক্রি এপ্রিলের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। তবে স্বাভাবিক সময়ের অর্ধেক বা তার কম। ফ্ল্যাটের বিক্রি নেই। রপ্তানি খাতে কার্যক্রম এখনো সীমিত।

শামসুল আলামিন রিয়েল এস্টেটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, ‘করোনায় সংক্রমণ রোধে লকডাউন শুরুর পর থেকে আমাদের সব প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। গত দুই মাসে কোনো বিক্রি হয়নি। কোনো ক্রেতা কিস্তি দেননি।’

কোম্পানিগুলো বলছে, তারা এখন কয়েকটি বিষয়ের ওপর জোর দিচ্ছে। ১. কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। ২. বিক্রি যতটা পারা যায় অব্যাহত রাখা ও ক্রেতার প্রয়োজন অনুযায়ী সাড়া দেওয়া। ৩. কোম্পানিতে অর্থের প্রবাহ যতটা পারা যায় নিশ্চিত করা। ৪. অংশীদার ও বিপণনে গুরুত্বপূর্ণ সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা।

সবাই এখন মোটামুটি অর্থকষ্টে রয়েছে। অনেকেই সরকারি প্রণোদনা নিয়েছে অথবা আবেদন করেছে। ব্যাংক ঋণ নিয়েই বেশির ভাগ খরচ চালাচ্ছে।

 ইস্পাত উৎপাদনকারী বিএসআরএমের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, করোনার প্রভাব শুরুর পর বড় প্রকল্পে রড সরবরাহের বিপরীতে পুরোনো বিলও আটকে আছে। এতে উৎপাদন খরচ ও বেতন–ভাতা চালিয়ে নিতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

শীর্ষ করপোরেটগুলো অন্য সব খাতে ব্যয় কমিয়ে কর্মীদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিচ্ছে। তারা মনে করছে, কর্মীরা হতোদ্যম হয়ে গেলে অথবা প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে না করলে আগামী দিনে ব্যবসায় ভালো করা কঠিন হবে।

ইউনিলিভার বাংলাদেশের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশনস শামীমা আক্তার বলেন, ইউনিলিভার প্রথম থেকেই যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা জন্য অর্থের জোগান নিশ্চিত করেছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে সুরক্ষিত রাখতে কাজ করা এবং উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় নিয়োজিত সবার জীবিকা নিশ্চিত করেছে।

করোনাকালে ব্যবসাক্ষেত্রে কিছু উপলব্ধিও এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, ব্যবসায় বৈচিত্র্য এনে ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে ফেলা। এক ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্য ব্যবসা দিয়ে যাতে টিকে থাকা যায়।

বার্জারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বলেন, করোনাকাল শেষে কেউ কেউ হয়তো স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের কথা ভাবতে পারে। যাদের ক্রেতাশ্রেণি অনলাইনে অভ্যস্ত, তারা হয়তো সেখানে জোর দিতে পারে। অবশ্য এখন চিন্তা করোনার প্রার্দুভাব কবে কমবে। তিনি বলেন, এখন কেউ দীর্ঘ মেয়াদে কোনো কিছু ভাবতে পারছে না। কোনোভাবে এই প্রান্তিকটা কাটিয়ে দিতে পারলেই ভালো।

চাহিদা কমার পূর্বাভাস

প্র বাণিজ্যের পক্ষ থেকে যাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগের পূর্বাভাস হলো চাহিদায় আগের মতো গতি থাকবে না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে। বিলাস পণ্যের চাহিদা কমবে। এ সময়ে কোম্পানিগুলো বাজার ধরে রাখতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দাম কমাতে পারে। আবার কিছু ক্ষেত্রে তারা দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি, ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা (অটোমোবাইল ও আবাসন), পণ্যের দাম কিছুটা কমিয়ে দেওয়া, মুনাফায় ছাড় দিয়ে বাজার হিস্যা ধরে রাখার কৌশল নেবে।

 নিত্যপ্রয়োজনীয় ও ব্যবহার্য পণ্যের ক্ষেত্রে মিনিপ্যাক ও ছোট প্যাকেটের বিক্রি বাড়তে পারে বলে ধারণা কারও কারও। তাঁরা বলছেন, যেহেতু ক্রেতা কম খরচ করতে চাইবেন, সেহেতু এখন আর বড় প্যাকেটে পণ্যের চাহিদা কম থাকবে।

 সিইওদের কেউ কেউ বলছেন, হোটেল-রেস্তোরাঁয় ক্রেতা কম থাকবে, সামাজিক অনুষ্ঠান কমে যাবে, মানুষ ঘুরতে যাবে কম—এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে ব্যবসার কৌশল সাজাতে হবে।

চাহিদা কমবে বিদেশেও। ফলে এ দেশের রপ্তানি খাত চাপে থাকবে। ক্রেতাদের প্রতিনিধিরা, বিদেশি কর্মীরা, মাননিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা কর্মীরা আপাতত বাংলাদেশে আসবেন না। এর ফলে যেসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা বেশি, তারা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে।

চীন থেকে সরে কিছু ব্যবসা বাংলাদেশেও আসতে পারে জানিয়ে তা ধরার জন্য প্রস্তুতির ওপর জোর দেন অ্যাপেক্সের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মোমেন ভূঁইয়া।

ব্রাজিল দল ও করোনাকাল

১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ফুটবল দল প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ে যায়। যদিও তারা আগের বারের চ্যাম্পিয়ন। পেলে একের পর এক ফাউলের শিকার হয়ে আর বিশ্বকাপে না খেলার হুমকি দিয়ে ফেলেন। পরের বার, ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপেই অসাধারণ ফুটবল শৈলির প্রদর্শন করে আবার চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল।

এ ঘটনা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক সংস্থা ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানির হংকংয়ের ম্যানেজিং পার্টনার কেভিন স্নেইডার ও সান ফ্রান্সিসকো কার্যালয়ের সিনিয়র পার্টনার বব স্টার্নফেলস লিখেছেন, ব্রাজিলের এই ফিরে আসার পেছনে ছিল উদ্ভাবন, বিশেষ করে অনন্য আক্রমণ কৌশল। ছিল সমন্বিত ও উদ্যোমী একটি দল। ছিল নেতৃত্ব, সেটা ব্যবস্থাপনায় ও মাঠে। ফলাফল, ব্রাজিল আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে।

কেভিন স্নেইডার ও বব স্টার্নফেলস মনে করেন, অনেকের জন্য নেতৃত্বের সবচেয়ে কঠিন সময়টি আসছে করোনাকালের পর।

কেভিন স্নেইডার ও বব স্টার্নফেলসের এই কথা প্রযোজ্য তো বাংলাদেশের জন্যও।