পণ্য রপ্তানি আয়ে টালমাটাল

করোনাভাইরাসের কারণে ১ হাজার ১৫০ কারখানার ৩১৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। ৪৬০ কোটি টাকা মূল্যের হিমায়িত চিংড়ির ২৯৯টি ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল করেছে বিদেশি ক্রেতারা। দুই মাস ধরে সবজি রপ্তানি বন্ধ। আসবাবে নতুন কোনো ক্রয়াদেশ আসছে না। আর চীনের কারণে গত জানুয়ারিতে প্রথম চামড়া খাতেই বিপর্যয় নেমেছিল।

ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনা জেঁকে বসার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি খাত টালমাটাল হয়ে পড়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে সংকট ততই বাড়ছে। রপ্তানি আয় তলানিতে ঠেকেছে। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা বাড়ছে। কাজ না থাকায় কারখানাও বন্ধ হচ্ছে। করোনায় আক্রান্তের এই সময়ে গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে রপ্তানি খাত।

 রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তবে করোনার কারণে এপ্রিলে সেটি এক ধাক্কায় কমে ৫২ কোটি ডলারে নেমেছে। ফলে সামগ্রিকভাবে অর্থবছরের দশ মাস শেষে রপ্তানি কমে গেছে ১৩ শতাংশ। পাট ও পাটপণ্য এবং আসবাব ছাড়া কোনো খাতের রপ্তানি আয় ইতিবাচক ধারায় নেই।

 বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান পণ্য রপ্তানি খাতের এই কঠিন সময়ে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অন্যদিকে রপ্তানিতে ঘুরে দাঁড়াতে বিভিন্ন খাতের উদ্যোক্তারা নতুন করে সুযোগ-সুবিধা দাবি করেছেন। শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রী রপ্তানিকারকদের জন্য কতটা হাত খুলবেন, সেটি সময়ই বলে দেবে।

 বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি না পেলে রপ্তানি আয় বাড়বে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমাদের শিল্পকারখানাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সে জন্য দুটি কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক. দেশের অভ্যন্তরে স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস করা। সেই সঙ্গে শ্রমিকদের পরীক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, ক্রেতাদেশগুলো যখন স্বাভাবিক হয়ে যাবে তখন যদি আমরা স্বাস্থ্যঝুঁকি মধ্যে থাকি, তবে পণ্য সরবরাহ করা যাবে না। দুই. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা। না হলে তারা টিকতে পারবে না।’

 নাজনীন আহমেদ আরও বলেন, রপ্তানিতে এত দিন পণ্যের দাম ও মান দিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হতো। করোনা–পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যগত অবস্থা ও সুনাম যুক্ত হবে। তাই শ্রমিক ছাঁটাই কিংবা মুজরি না দেওয়ার কারণে খারাপ ভাবমূর্তি তৈরি হলে ক্রেতা হারানোর শঙ্কা থাকবে। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি মালিকদেরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

>

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত কারখানা টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ
ইতিমধ্যে শ্রমিক ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধের মতো ঘটনা ঘটছে

 ভারতভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াজির অ্যাডভাইজরস এক গবেষণায় বলেছে, করোনায় বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের চাহিদা ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) সেটি কমতে পারে ৪০ শতাংশ আর জাপানে ২০ শতাংশ। এতে করে চলতি বছর তিনটি দেশ ১২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি কমিয়ে দিতে পারে।

 যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বড় বাজার। আর পোশাকই ৮০ শতাংশের বেশি রপ্তানি আয় নিয়ে আসে। করোনায় প্রথম ধাক্কায় ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হওয়ায় পোশাক রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। সামগ্রিকভাবে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত তিন মাসে পোশাক রপ্তানি কমে গেছে ৫৪ শতাংশের মতো। নতুন ক্রয়াদেশের পরিমাণও কম। যদিও সংকটের একেবারে শুরুতেই পোশাকশ্রমিকদের তিন মাসের মজুরি দিতে ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল দিয়েছিল সরকার। তারপরও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। ঈদের পর সেটি নতুন করে বেড়েছে। অন্যদিকে ৪২০টি কারখানাও বন্ধ হয়েছে।

 তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি আরশাদ জামাল প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ক্রেতারা যে পরিমাণে নমুনা বা ‘স্যাম্পল’ করাচ্ছেন তাতে মনে হচ্ছে ৩০-৪০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কমে যাবে। তবে চীন থেকে ক্রয়াদেশ সরলে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে।

 পোশাকের মতো দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত চামড়া ও চামড়া পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৭০ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়া পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম। আর গত এপ্রিলে মাত্র ১ কোটি ২৪ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়া পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

 বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানির ঈদ চলে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নীতিসহায়তা না দিলে কোরবানির চামড়া কেনা নিয়ে গতবারের চেয়ে খারাপ অবস্থা সৃষ্টি হবে। তাতে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও চামড়া রপ্তানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই।