করোনাকালের অর্থনীতি নিয়ে চার ব্যবসায়ী নেতার অভিমত

>

অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ এখন সবার। টিকে থাকার জন্য নানামুখী উদ্যোগ আছে ঠিকই, শঙ্কা আছে বাস্তবায়ন নিয়েও। এ রকম এক সময়ে আসছে নতুন বাজেট। এই বাজেটে আশার আলো দেখতে চান উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বে আছেন যাঁরা। এ নিয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও তিনটি চেম্বারের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজীব আহমেদ, শুভঙ্কর কর্মকারমাসুদ মিলাদ

শেখ ফজলে ফাহিম
শেখ ফজলে ফাহিম


মুনাফা নয়, বছরটা আসলে টিকে থাকার
শেখ ফজলে ফাহিম

যে পরিস্থিতিতে আমরা আছি, একটা কথা তো প্রায়ই আলোচনা হয়, জীবন আগে, না জীবিকা আগে। অবশ্যই জীবন আগে। তবে জীবিকাও দরকার। আমাদের দুয়ের সমন্বয় করেই চলতে হবে।

ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা যদি বলি, এ বছরটা হচ্ছে টিকে থাকার বছর, মুনাফা করার নয়। পারস্পরিক সহযোগিতার ভালো দিক, সরকার বড় প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে।

আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে যেটুকু বুঝেছি, কোনো কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দুই মাসের জন্য সুদ স্থগিত রাখা, তারল্য পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে গণমাধ্যমে অসত্য তথ্য দিচ্ছেন। তিনটি থিঙ্কট্যাংক (নীতি পর্যালোচনা সংস্থা) ও কিছু ব্যাংকার বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা করছেন, যা একেবারে ছোটদের প্রণোদনার আওতায় আনতে বাধা তৈরি করছে। তাঁরা তারল্য সমস্যা হবে, মুনাফা কমবে ইত্যাদিকে বড় করে দেখাচ্ছেন। তবে বেশির ভাগ ব্যাংকারের মনোভাব ইতিবাচক।

অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক মিলে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা কিছু ব্যাংকারের যোগসাজশে এমন একটি মিথ্যা ধারণা তৈরির চেষ্টা করছেন যে ব্যাংক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে পারবে না। তাঁদের বিপুল লোকসান হবে। তাঁরা বলছেন, এক বছরের স্থগিত সুদ মওকুফ করে দেওয়া হচ্ছে, এটা কিন্তু সরকার বলেনি।

কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাত, সবার জন্যই কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যেখানে ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদই পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ৪ শতাংশ ও বাকিটা গ্রাহক দেবে। ব্যাংকঋণের মাধ্যমে ছোটরা অনানুষ্ঠানিক থেকে আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে আসবে। এটি দেশের কর-জিডিপি ও বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাতে বাড়ানো, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) পূরণে ভূমিকা রাখবে।

অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বড়দের তুলনায় এসএমইদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের পরিস্থিতি ভালো থাকে। এখন সবাইকে যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ব্যাংকগুলোকেও বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা দেখছি, বারো মাসে তেরো বোনাস পাওয়া ব্যাংকের কিছু এমডির ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের প্রতি উৎসাহ বেশি। এসএমইদের প্রতি অনীহা। করোনা পরিস্থিতিতে তাঁদের ভূমিকা দুঃখজনক।

আমরা জেলায় জেলায় বৈঠক শুরু করেছি। বিভাগীয় চেম্বারগুলো দিয়ে কাউন্সিল গঠন করেছি। এখানে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের প্রতিনিধিরাও থাকছেন। গ্রাহকদের জানতে আমরা ব্যাংককে সহায়তা করব।

বাজেটে আমরা এফবিসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে করসহ বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা চাই করোনার ক্ষতি কাটাতে প্রণোদনার দ্বিতীয় পর্যায় হিসেবে কিছু কর ছাড় দেওয়া হোক। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতে। বিদেশ থেকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিয়ে এসএমইদের জন্য প্রয়োজনে কিছু অনুদানও দিতে হবে।

এ বছরটা টিকে গেলে আগামী বছর ভালো কিছু অপেক্ষা করছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। এফবিসিসিআই সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে। আমরা প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকের পাশে দাঁড়াতে চাই। 

নিহাদ কবির
নিহাদ কবির


সরকার একটি পরামর্শক কমিটি করতে পারে
নিহাদ কবির

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে একটাই বিষয় জানা গেছে যে অদূর ভবিষ্যতে বহু ‘অজানা চ্যালেঞ্জ’ দেখা দেবে এবং ক্ষিপ্রতার সঙ্গে এই নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। তারপরও বর্তমান অবস্থা মোকাবিলা করে এর থেকে উত্তরণের পরিকল্পনা করতে হবে, কিন্তু সে পরিকল্পনা হতে হবে এমন, যা ঘটনাক্রমের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দ্রুত পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করা যায়।

এই পরিপ্রেক্ষিতেই আসছে বাজেট। আর তাতে শুধু চিরাচরিত গতানুগতিক আয়-ব্যয়, অর্থবরাদ্দ-অর্থসংস্থান, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার, ঘাটতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়গুলোর বাইরে বেরিয়ে ভবিষ্যদ্দর্শী কিছু আমরা দেখতে চাই, যেন আমাদের মনোবল বাড়ে এবং আমরা আশার আলো দেখতে পাই।

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে তাই প্রথমেই চাইব যেন বাজেট এবং রাষ্ট্রের সমস্ত কার্যক্রমের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য হয় করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশব্যাপী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। এটা নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব এবং দেশের মানুষের প্রতি একটি অঙ্গীকার। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিগত কয়েক মাসে স্বাস্থ্য খাতে গুরুতর অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের অভাব প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ না করে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে বলে আমি মনে করি না। এখনো অল্প সময় হাতে আছে, এর সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে সরকারের প্রস্তাবিত কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব এবং একান্ত প্রয়োজন।

জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা শুধু আমাদের সাংবিধানিক ও সামাজিক দায়িত্বই নয়, বর্তমানে দৃশ্যমান এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এটা একটা আবশ্যিকসহ পূর্বশর্ত, যে কারণে ব্যক্তি খাতের প্রতিনিধি হিসেবেও এর ওপর যথাসাধ্য জোর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। এর কয়েকটি দিক আছে। অর্থনীতি তখনই পূর্ণোদ্যমে সচল হবে, যখন দেশের মানুষ অনেকটা নির্ভয়ে কর্মক্ষেত্র ও সমাজজীবনে ফিরতে পারবেন। যাঁরা শ্রমিক ও কর্মী, তাঁদের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে তাঁরা কাজে ফিরতে পারবেন না বা ফিরলেও উৎপাদনশীলতা ব্যহত হবে। আবার যত দিন পর্যন্ত দেশে সংক্রমণের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা থাকবে, আমাদের ব্যবসাবাণিজ্য, অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ বিদেশি অংশীদার বা সহযোগীরা ফিরে আসতে বা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না এবং সে ক্ষেত্রে তাঁরা অন্য প্রতিযোগী দেশের প্রতি আকৃষ্ট হবেন। আমরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়তে পারি, এ আশঙ্কা যথেষ্ট যৌক্তিক।

স্বাস্থ্য ও জীবিকার সংকট, ব্যয় বৃদ্ধি, আয়ে ধস ও মধ্যমেয়াদে অর্থনীতির সংকোচন—এসব কঠিন বাস্তবতার কথা আমরা অনেকেই কয়েক সপ্তাহ ধরে বলে আসছি। এমসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক চিঠিতে আমরা বিনীত অনুরোধ করেছিলাম, পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে পরিমাপযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণসহ সংকট উত্তরণের একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করতে সরকার অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সমাজবিজ্ঞানী ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করতে পারে। এ রকম একটি কমিটি এখনকার পরিস্থিতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল বা অন্তত এর প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি করে দিলে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাজেট তৈরি হলে তা অনেক কার্যকর হতো বলে মনে হয়। এ ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

এবার সরাসরি বাজেটের কথায় আসি। এবারের বাজেট হতে হবে জনস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের বাজেট, কর্মসংস্থান ফিরিয়ে আনার বাজেট এবং অভ্যন্তরীণ সামষ্টিক চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করার বাজেট। এ বছর, এমনকি সামনের দু-তিন বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারের ওপর মনোনিবেশ না করে দেখতে হবে সরকার সাধারণ মানুষের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা কত দূর নিশ্চিত করতে পারছে। ৮ শতাংশের ওপর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধার্য করা যেতে পারে, তবে তা অর্জন না করার আশঙ্কাই বেশি। অতএব এ ধরনের প্রক্ষেপণের ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করলে তা ভবিষ্যতের জন্য সঠিক পথ নির্দেশ করবে না।

সবশেষে, এবারের বাজেটে রক্ষণশীলতা নয়, সাহসিকতা এবং ভবিষ্যন্মুখী চিন্তা ও পরিকল্পনাই আমাদের আশ্বস্ত করবে। 

মাহবুবুল আলম
মাহবুবুল আলম


অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো দরকার
মাহবুবুল আলম

চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ বাড়ার পর বাসা থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করছি। বাসা থেকে বের হলে নিজে ও পরিবারের সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনেও চলছি। করোনার এই দুঃসময়ে ব্যবসায়ীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এ জন্য চেম্বার থেকে চট্টগ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ১৫টি স্থানে বাজারদরের অর্ধেক মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রির উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।

করোনা মানুষকে বড় শিক্ষা দিয়েছে। করোনা সংক্রমণের ক্ষেত্রে ধনী–গরিব কোনো ভেদাভেদ নেই। মানুষ মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসছে। এখন দোষত্রুটি না খুঁজে একজন আরেকজনের সহায়তায় এগিয়ে আসতে হবে। যুদ্ধটা সবাই মিলে একসঙ্গে করতে হবে।

করোনার প্রভাবে এখন ব্যবসা–বাণিজ্য কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। এ অবস্থা কত দিন থাকবে, তা আমরা কেউ জানি না। ছয় মাসের বেশি যদি ব্যবসা–বাণিজ্যে এ অবস্থা চলতে থাকে তাহলে কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন। বিশেষ করে হোটেল–রেস্তোরাঁ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে, তা খুবই ইতিবাচক। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার জন্য এই প্রণোদনা ও সরকারের নানা উদ্যোগ খুব কাজে দেবে। পাশাপাশি করোনা আরেকটি শিক্ষা দিয়েছে যে ব্যবসা–বাণিজ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত খরচের দরকার নেই। এখনই দরকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় খরচ চিহ্নিত করে তা কমিয়ে আনা।

 আমরা জানি, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। করোনার এই সময়ে সাধারণত কোনো ব্যবসায়ী তার প্রতিষ্ঠানের জনবল ছাঁটাই করতে চাইবে না। ব্যবসা সব সময় এ রকম চলবে না—এটা মেনেই ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন। কখনো কখনো কঠিন সময় আসতে পারে। এবার হয়তো তা লম্বা সময় ধরে দুঃসময় যাচ্ছে। এরপরও করোনার এই দুর্দিনে জনবল ছাঁটাই করা যুক্তিসংগত নয়। এটা মানবিকতা না। এখন যদি ছাঁটাইয়ের হার বাড়ে তাহলে বেকারের সংখ্যা বাড়বে। সমাজে কিন্তু এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সমাজে অস্থিরতাও তৈরি হতে পারে। ব্যবসায়ীরাও নিশ্চয়ই কেউ তা চাইবে না। আবার এ সময় নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগও কম। ফলে আমি বলব, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আনা গেলে ছাঁটাই না করেও ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায়।

 আমরা বিশ্বাস করি, এই অবস্থার একদিন পরিবর্তন হবে। তার আগ পর্যন্ত নিজে সুস্থ থাকা বেশি দরকার। কর্মসংস্থানের জন্য হলেও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা দরকার। কারণ, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে। সেটি আমরা পারব। আমাদের উদ্যোক্তারা পারবেন।

শামস মাহমুদ
শামস মাহমুদ


টিকে থাকতে নতুন করে ভাবতে হবে
শামস মাহমুদ

করোনাভাইরাসের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, এ রকম আগে কখনো হয়নি। এটি একটি নতুন অভিজ্ঞতা। আমাদের পণ্যের মূল বাজারে লকডাউনের কারণে রপ্তানি কমে গেছে। মৌসুমি ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে অতি ক্ষুদ্র বা কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি এবং বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূল সমস্যা হয়েছে, প্রায় প্রত্যেকের নগদ অর্থের লেনদেন কমে গেছে। চলতি মূলধনে টান পড়েছে।

সরকার করোনাসংকট মোকাবিলায় প্রাথমিকভাবে কয়েকটি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এটি ভালো উদ্যোগ। সেখান থেকে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের শিল্প খাতের (এমএসএমই) উদ্যোক্তারা এখনো ঋণসহায়তা পাননি। অথচ পণ্য রপ্তানি যখন ব্যাপকভাবে কমে গেছে, তখনো এমএসএমই খাত দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে। তাই তাদের অবদান ভুলে গেলে চলবে না। এমএসএমই উদ্যোক্তাদের সহায়তায় ব্যবসায়ীদের সংগঠনসহ সবাইকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

বিশ্ববাজারে তেলের দাম পড়ে গেছে। নির্মাণ খাত শ্লথ হয়ে পড়বে। ফলে অনেক প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসবেন। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে তাঁদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। এ জন্য বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা যেন তাঁদের ব্যবসা সম্প্রসারণ ও নতুন বিনিয়োগ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। তবে ব্যাংকের ওপর সব চাপ দেওয়া যাবে না। কারণ, ব্যাংকে যে টাকা থাকে, তা জনগণের আমানত। কোনো কারণে যদি ব্যবসা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হয়, তাহলে বড় সমস্যা হয়ে যাবে। সে জন্য করপোরেট কর কমানো ও পুঁজিবাজারকে চাঙা করার পাশাপাশি বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে স্বল্প সুদে উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া যেতে পারে।

চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। তবে এবার জিডিপির প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের আগে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। করোনা সংকট মোকাবিলায় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা লাগবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে সেই দিকনির্দেশনা থাকতে হবে। আর অবশ্যই নতুন কর্মসংস্থান যেন সৃষ্টি হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ না থাকলে অনেকে ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিতে পারেন। আগস্ট মাসে ক্রয়াদেশ পরিস্থিতি দেখে হয়তো অনেকে সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার পর অনেক বিদেশি ক্রেতাই সস্তায় পোশাক বানাতে বাংলাদেশমুখী হয়েছিল। করোনা-পরবর্তী সময়েও তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণেও বাড়তি ক্রয়াদেশ আসতে পারে। সুযোগগুলো কাজে লাগাতে আমাদের বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনে যেতে হবে। তার জন্য গবেষণা ও উন্নয়নে জোর দিতে হবে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের উদ্যোক্তাদের অনেকেই অপরিকল্পিতভাবে ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন। টিকে থাকতে হলে তাঁদের অবশ্যই নতুন করে ভাবতে হবে।

শেখ ফজলে ফাহিম: সভাপতি, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিশামস মাহমুদ, নিহাদ কবির: সভাপতি, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, মাহবুবুল আলম: সভাপতি, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রি, শামস মাহমুদ: সভাপতি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি