অর্থমন্ত্রীর রাজস্ব নীতিতে জাদু নেই

জাহিদ হোসেন
জাহিদ হোসেন

এত বিশাল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির জন্য বাজেটে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। আগামী অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য অর্থমন্ত্রীর কাছে জাদু হলো রাজস্বনীতি (ফিসক্যাল পলিসি)। কিন্তু তিনি সেই জাদু দেখাতে পারেননি। তিনি যেসব নীতি নিয়েছেন, তা ভোক্তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। যেমন, মোবাইল ফোন সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে কথা বলায় খরচ বাড়বে। আবার অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রেও খরচ বাড়বে। ভোক্তারা খরচ করতে নিরুৎসাহিত হবেন।

তবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে কিছুটা স্বস্তিও দেওয়া হয়েছে। সার্বিকভাবে ভোক্তারা ভোগ না করলে কীভাবে প্রবৃদ্ধি আসবে? এ ছাড়া করোনার কারণে এমনিতে তাঁদের আয় ও ভোগ বেশ কমেছে।

করোনা সংকটের কারণে আমরা এখনো অর্থনীতির তলানিটা দেখতে পাইনি। করোনা সংক্রমণের সংখ্যা এখনো বাড়ছে। ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে আগে অর্থনীতিকে তলানিতে যেতে হবে। তারপর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। কবে অর্থনীতি তলানিতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে, সেটাও নিশ্চিত করে বা যাচ্ছে না। আগামী ৬ থেকে ৮ মাস করোনা পরিস্থিতি ঠিক হবে, তা বলা যাচ্ছে না। ফলে ভোগ, বিনিয়োগ, প্রবাস আয়, রপ্তানি খাত আগের অবস্থায় আসার সম্ভাবনা কম। তাহলে কোন বিশ্বাসে অর্থমন্ত্রী এত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দিলেন?

একমাত্র কৃষি খাতই করোনা সংকটের মধ্যে প্রায় স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। কিন্তু কৃষি খাত থেকে জিডিপির ২০ শতাংশের মতো আসে। এই খাতে সাধারণত ৪ থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। এ খাতে আগামী বছর ৫ শতাংশ হবে বলে ধরে নিলেও প্রবৃদ্ধির বাকিটা আসতে হবে শিল্প ও সেবা খাত খাত। এর মানে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শিল্প ও সেবা খাত থেকে বাকি সোয়া ৭ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি আসতে হবে।

বিনিয়োগ চাঙা করার জন্য সরকারের তরফ থেকে করোনার আগে থেকেই নানা উদ্যোগের কথা শুনে আসছি। এ বাজেটে নতুন কিছু নেই। বাস্তবে বিনিয়োগকারীরা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা মধ্যে পড়ছেন। তবু সার্বিকভাবে বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি হলেও এ মুহূর্তে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন না। কারণ দেশে-বিদেশে পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে গেছে। জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগ গত কয়েক বছরে গড়ে মাত্র ১ শতাংশের মতো বেড়েছে।

এবার দেখতে হবে, যেসব কারণে প্রবৃদ্ধি হয়, অর্থনীতির যেসব সূচক কী অবস্থায় আছে। করোনার আগেই অর্থনৈতিক প্রায় সূচক নিম্নমুখী ছিল। করোনা শুরু হওয়ার পর মানুষের আয় কমেছে, ফলে ভোক্তা ব্যয়ও কমেছে। এ ছাড়া বেসরকারি বিনিয়োগে ঋণপ্রবাহে শ্লথগতি; রপ্তানি আয়ে ধস; প্রবাস আয় কমেছে। মার্চের পর অর্থনীতির প্রতিটি সূচক নিম্নগামী। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে এই সূচকগুলোর উন্নতির সম্ভাবনা কম। এখনো বলতে পারছি না, করোনার শেষ কোথায়?

করোনা আসার আগেই ভোক্তা ব্যয় কমে যাচ্ছিল। দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, রাজস্ব খাতে ভ্যাট আদায়ে তেমন প্রবৃদ্ধি নেই। ভোক্তা ব্যয়ের সঙ্গে ভ্যাট আদায়ের সংযোগ আছে। করোনা আগে চলতি অর্থবছরের প্রথম কয়েক মাসে ভ্যাট আদায়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নতুন আইন করেও ভ্যাট আদায় বাড়ানো যায়নি।

আবার প্রতিবছর শীতের সময় এক মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা হয়। এটি অনেকটা উৎসবের মতো, নিত্যপণ্য বেশি বিক্রি হয়। দেখা গেছে, সেখানে দর্শনার্থীর সংখ্যা কমেছে, বেচাকেনাতে প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে কম। আসলে ভোক্তাদের খরচ করার সামর্থ্যও কমছে।

সার্বিকভাবে বলা যেতে পারে, ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে কোভিড সংকট থেকে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এখনো আমরা অর্থনীতিকে সেই অবস্থানে নিতে পারিনি। ভোক্তার খরচ করার সামর্থ্য বাড়াতে হবে, আবার বিনিয়োগকারীর আস্থাও ফিরিয়ে আনতে হবে।

লেখক: বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ