জাতীয় বাজেট: স্বাস্থ্য সুরক্ষা হোক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিপর্যয় মোকাবিলার লক্ষ্যে ১১ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করেন। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে ১৩.২ শতাংশ বেশি। টাকার অঙ্কে এই পার্থক্য ৬৬ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের ঘাটতির চেয়ে ৩৬ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা বেশি। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে এই ঘাটতি পূরণ হবে।

২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রস্তাবিত মোট বাজেটের ৫ দশমিক ২ শতাংশ অর্থাৎ ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৩ হাজার কোটি টাকার মতো বেশি। প্রসঙ্গত, ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকা।

অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। কারণ, তিনি চারটি খাতকে এবার সর্বাধিক অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যার শীর্ষে রয়েছে স্বাস্থ্য। তিনি বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য খাতকে এবার সর্বাপেক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে এ খাতে অতিরিক্ত বরাদ্দ প্রণোদনা ও ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’ তবে মোট বাজেটে শতকরা হিসেবে স্বাস্থ্য খাত বরাদ্দ পেয়েছে মাত্র ৫ দশমিক ২ (৫.২%) ভাগ। অন্যদিকে তার চেয়েও বেশি বরাদ্দ আছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, জনপ্রশাসনে, সুদ পরিশোধ, স্থানীয় সরকার, পরিবহন ও যোগাযোগে।

জনগণ এখন প্রতিদিনই আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছে, আর সামনে অনিশ্চয়তা। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে সরকার ব্যাপক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের আওতায় বর্তমানে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মানুষের জীবন রক্ষা আর জীবিকার নিশ্চয়তা দিতেই বিশাল বাজেট প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, যেখানে নতুন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। জরুরি চাহিদা মেটাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের প্রস্তাবও করেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে বরাদ্দ বাড়লেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার ব্যবহার কতটা করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। গত বাজেটে ২৫ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও পরে তা সংশোধন করে ২৩ হাজার ৬৯২ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছিল। তাই স্বাস্থ্য বাজেটের কার্যকর বাস্তবায়ন দরকার।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাতে এত দিন কতটা কম মনোযোগ দেওয়া হয়েছে এবং কত বড় ধরনের সংস্কার এ ক্ষেত্রে দরকার। বাজেটে কি তার প্রতিফলন হয়েছে? এটা চিরায়ত যেটা থাকে, বাজেটের ৫ দশমিক ২ (৫.২%) শতাংশ আর জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ—এই বছরও বাড়েনি। তবে করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্য বাজেট বাড়ানো যেত। কারণ, সর্বজনীন স্বাস্থ্য তো এক বছরে হবে না। অর্থমন্ত্রী সব সময় টেকসই উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেন। এবার তাঁর কাছে জনগণের আশা ছিল স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সামরিক, উন্নয়ন ও শিক্ষার বাজেট তৈরি করবেন। কিন্তু সেটি হয়নি। কারণ, এখন টেকসই উন্নয়ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক লক্ষ্য। এর একটি ভিত্তি নির্মাণের প্রচেষ্টা থাকলে বাংলাদেশ সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে যেতে পারত। এবারও সেখানে কেন যেন সমস্যা রয়ে গেল।

কোভিড-১৯–এর স্বাস্থ্যঝুঁকি বিশ্বকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যাবে, তা এখনো অজানা। করোনার কারণে অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে যাচ্ছে বিশ্বসহ আমাদের বাংলাদেশ। অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে কত দিন লাগবে, তা-ও কেউ বলতে পারছেন না। সেদিন জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কোনো শক্তি কাজে লাগছে না। করোনাভাইরাসই যেন সবচেয়ে শক্তিশালী।’ আসলেই তাই। করোনাভাইরাস একটি অদৃশ্য শত্রু, যার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সবাইকে। এটি কেবল সরকার বা সুনির্দিষ্ট বাহিনীর দায় নয়। এটি একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার ইস্যু। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশাল স্বাস্থ্য বাজেট থাকা সত্ত্বেও মহামারির ভয়াবহ পরিণাম দেখছেন।

করোনাযুদ্ধ আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দিচ্ছে। স্কুলে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হতো ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’। অথচ আমরা দেশের সুখ, শান্তি ও উন্নয়ন যদি চাই স্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে, যা কখনোই সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদের অর্থ মন্ত্রণালয়কে মনে রাখতে হবে, উৎপাদন বাড়ানোকে উন্নয়ন ভাবলে আর চলবে না। উন্নয়ন হবে স্বাস্থ্যকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে। সুতরাং, ভাবতে হবে আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পরস্পর অবিচ্ছেদ্য।

আজ বিশ্ববাসীর নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে। আর এটা হয়েছে স্বাস্থ্যকে অবহেলা করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ অনেকের পারমাণবিক বোমা আছে, আরও আছে অনেক আধুনিক মারণাস্ত্র, সাবমেরিন, এফ-১৬, মিগ-২৯ ফাইটার জেট ও আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল। কিন্তু সেগুলো কোনো কাজে আসছে না এখন। সেই ভুল আর করা ঠিক হবে না। তাই স্বাস্থ্য সুরক্ষা হোক দেশের সুখ, শান্তি ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু—এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত, স্বাস্থ্যব্যবস্থা অথবা স্বাস্থ্য ক্যাডারকে আলাদা করে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস ক্যাডারের মতো বাংলাদেশ মেডিকেল সার্ভিস ক্যাডার আলাদা করে, তার সুযোগ-সুবিধা সব ক্যাডারের ওপরে রাখতে হবে; যেন এই ক্যাডারের সদস্যরা নিবেদিতভাবে দেশের জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারেন। আর এই ক্যাডারে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেন দেশের সবচেয়ে মেধাবী, সৎ, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক ছাত্রদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

সুযোগ-সুবিধা এমনভাবে হোক, যাতে জুনিয়র ডাক্তার যেন একটি মোটরসাইকেল পান, যাতে করে রোগীর কাছে দ্রুত যেতে পারেন। সব উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে একটি গাড়ি দেওয়া হয়। এবার যেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা একটি গাড়ি পান। এবার যেন একজন ডাক্তার ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি কিনতে পারেন। এবার যেন হাসপাতালে ওষুধ, টেস্টিং ল্যাবরেটরি, ভেন্টিলেটর, আইসিইউ, ডায়ালাইসিস, ক্যানসারের চিকিৎসার সুবিধা থাকে। বাংলাদেশ মেডিকেল সার্ভিস কমিশনের মতো আলাদা অথরিটির নেতৃত্বে সারা দেশে একযোগে হেলথ ইনস্যুরেন্স বা স্বাস্থ্যবিমা চালু করা, যাতে কোনো ডাক্তার রোগীর কাছ থেকে বেশি ফিস বা টাকা নিতে না পারেন। এতে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় একটা সুস্থ পরিবেশ বিরাজ করবে। আর সামরিক মহড়ার মতো বিভিন্ন জরুরি মহামারির ডামি মহড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাই স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিতে হবে। স্বাস্থ্য নিরাপত্তা হোক আমাদের মূল বাজেট ভাবনা।

লেখক: অধ্যাপক, শিশু সার্জারি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও সদস্যসচিব, বাংলাদেশ হেলথ ইকোনমিস্ট ফোরাম।
ই–মেইল: [email protected]