গোলমেলে তথ্যে মিলছে না বিনিয়োগ হিসাব

আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো কৌশলের কথা আর জানালেন না অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বিনিয়োগের হার চলতি অর্থবছরের জন্য সংশোধন করে যা করা হয়েছে, আর আগামী অর্থবছরের জন্য যা ধরা হয়েছে, তার মধ্যে শতভাগ পাথর্ক্য। অর্থমন্ত্রী বা সরকারের পক্ষ থেকে এর কোনো ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়নি। 

চলতি ২০১৯–২০ অর্থবছরে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ৬ শতাংশ আর বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। কোভিড-১৯–এর কারণে এক ধাক্কায় সরকার তা সংশোধন করে মোট বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে এনেছে ২০ দশমিক ৮ শতাংশে। এর মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ সামান্য কমিয়ে ৮ দশমিক ১ করা হয়েছে, আর বেসরকারি বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ঠিক করেছে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বব্যাংক যে বলেছে, চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার  ১ শতাংশ হবে, বেসরকারি বিনিয়োগের এই লক্ষ্যমাত্রাকে ভিত্তি ধরলে চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশও হবে না। এটা নেগেটিভ হয়ে যাবে।

কোভিড-১৯–এর সংক্রমণ এখনো চলমান। দিন দিন বরং বাড়ছে। কখন শেষ হবে, কেউ বলতে পারে না। শেষ হলেও এর প্রভাব থাকবে লম্বা সময় ধরে। এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী যে বাজেটে ঘোষণা করলেন, তাতে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রশ্নে তিনি ইউটার্ন নিলেন। বললেন, আগামী অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ হবে ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আর সরকারি বিনিয়োগ হবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার সমান, অর্থাৎ ৮ দশমিক ১ শতাংশ।

বিনিয়োগ কৌশল নেই
কৌশলটা কী, কীভাবে তা সম্ভব হবে, হলে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী কী জানালেন, তা মিলিয়ে দেখা যায়। 

এবারের ১১০ পৃষ্ঠার (পরিশিষ্ট বাদে) বাজেট বক্তব্যে বিনিয়োগ বা বেসরকারি বিনিয়োগ—কোনোটি নিয়েই আলাদা কোনো অধ্যায় নেই। পঞ্চম অধ্যায়ের সংস্কার ও সুশাসন অংশে অর্থমন্ত্রী শুধু বলেছেন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়নে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

আগের অর্থবছরের বাজেট বক্তব্যেও বিনিয়োগ নিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রায় একই কথা বলেছিলেন। তবে গতবার থেকে এবার বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার কোটি ডলার হয়েছে বলে জানান তিনি।

বাজেট প্রস্তাবের দিন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মধ্য মেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশের উন্নয়ন চাহিদা মেটাতে সরকার ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছে। এতে কর্মসংস্থানের বাড়তি সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ২ শতাংশ। দীর্ঘদিন ধরে বেকারত্ব এই হারের কাছাকাছি আছে এবং ভবিষ্যতে একটা দীর্ঘ সময় জুড়েও এই হারের কাছাকাছিই থাকবে। অর্থাৎ কোভিড-১৯–এর কোনো প্রভাব বেকারত্বের হারে পড়ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে না।

তবে অর্থমন্ত্রী বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে গত শুক্রবার বলেছিলেন, ‘কোন পথে বিনিয়োগ আসবে, এত দিন জানতাম না। এখন জানি। এ জন্য আইনগুলো সহজ করে দিচ্ছি। স্থানীয় ও বিদেশি—সবাই একই পণ্য উৎপাদন করতে পারবে। দুই ক্ষেত্রে একই ধরনের সুবিধা দেওয়া হবে।’

ব্যাংকঋণে সুদহার কমিয়ে ৯ শতাংশ করে দেওয়াটাও আরেকটা কৌশল বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। শুক্রবার তিনি বলেন, ‘সুদহার বেশি হলে খেলাপি ঋণ বাড়ে। মানুষ তখন দেশে বিনিয়োগ করতে চান না। এখন আর সেটা হবে না। কারণ, আমরা সুদহারকে ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছি।’

প্রবৃদ্ধির হার শূন্যের নিচে নামার শঙ্কা
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, মাত্র তিন মাসে বেসরকারি বিনিয়োগ হারের লক্ষ্যমাত্রা ২৪ দশমিক ২ থেকে কমে ১২ দশমিক ৭ হবে—এমন পতন অবিশ্বাস্য, অপ্রত্যাশিত এবং আতঙ্কিত হওয়ার মতো।

আহসান মনসুর আরও বলেন, এটা সত্যি হলে চলতি অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হারের লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে যে ৫ দশমিক ২ শতাংশ করা হয়েছে, তা–ও অর্জিত হবে না। এটা তখন শূন্য শতাংশেরও কম হবে।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধির হার চলতি অর্থবছরে সংশোধন করে যা ধরা হয়েছে তাই হবে। আর আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হবে। সেই লক্ষ্যে বছরব্যাপী আমরা কাজ করে যাব।

বেসরকারি বিনিয়োগের চিত্র সম্পর্কে ধারণা পেতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান আলী রেজা ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধির হার গত এপ্রিল পর্যন্ত ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ। অর্থবছর শেষে তা ১২ শতাংশের মতোই হবে।’

২০১৮-১৯ ২০১৯-২০ ২০১৯-২০ ২০২০-২১ ২০২১-২২ 

প্রকৃত বাজেট সংশোধিত প্রক্ষেপণ প্রক্ষেপণ

মোট ৩১.৬ (জিডিপির) ৩২.৮ ২০.৮ ৩৩.৫ ৩৪.৫

বেসরকারি ২৩.৫ (জিডিপির) ২৪.২ ১২.৭ ২৫.৩ ২৬.৬

সরকারি ৮.০ (জিডিপির) ৮.৬ ৮.১ ৮.১ ৭.৯