তিন মাস পরে বাজেটের মূল্যায়ন প্রয়োজন

নিহাদ কবির
নিহাদ কবির

প্রতিবছর বাজেট সামনে প্রকাশিত হলেই আমরা বসে যাই ‘কি পাইনি তারি হিসাব মিলাতে ...’। ভাবটা এই যেন এই একটিমাত্র দলিলে আমাদের আগামী বছরের জীবনের সমগ্র রূপরেখা বিধৃত থাকবে। আমরা চেম্বার অব কমার্স এবং অন্যান্য সংগঠন থেকে দিনের পর দিন আলোচনা করে ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের মধ্যে বহু দাবিদাওয়া ও পরামর্শ দিয়ে ফেলি। জুনে দেখা যায় তার সামান্যই হয়তো বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে। এটা সত্যি, আমরা কী আছে না আছে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত থাকি। কারণ মনে হয় না পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে বছর বছর কর বা শুল্কের হার এবং এর আওতার এত পরিবর্তন হয়, বা বাজেটের পরেই এসআরও দিয়ে পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। 

 প্রথমেই সবার নজর স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেড়েছে, তবে বহু সুধীজন এবং বিশেষজ্ঞরা বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সে অনুপাতে বরাদ্দ বাড়েনি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিগত কয়েক মাসে স্বাস্থ্য খাতে গুরুতর অব্যবস্থাপনা এবং সমন্বয়ের অভাব প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। তাদের সক্ষমতার অভাবের কারণেই হয়তো বরাদ্দ খুব বেশি বাড়েনি। স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ না করে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে বলে আমি মনে করি না। তাই এতে আমি খুব একটা হতাশ বা চিন্তিত নই। এ খাতের সামর্থ্য, ব্যবস্থাপনা এবং জবাবদিহি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতেই হবে এবং অতি দ্রুত। সেটা কীভাবে হবে, তা নিয়ে বরং আমার চিন্তা বেশি। 

 জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা শুধু আমাদের সাংবিধানিক ও সামাজিক দায়িত্বই নয়, বর্তমানে দৃশ্যমান এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এটা একটা আবশ্যিক পূর্বশর্ত। এর কয়েকটি দিক আছে। অর্থনীতি তখনই পূর্ণ উদ্যমে সচল হবে যখন দেশের মানুষ অনেকটা নির্ভয়ে কর্মক্ষেত্র এবং সমাজজীবনে ফিরতে পারবে। যাঁরা শ্রমিক এবং কর্মী, তাঁদের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে তাঁরা কাজে ফিরতে পারবেন না, বা ফিরলেও উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হবে। আবার যত দিন পর্যন্ত দেশে সংক্রমণের উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা থাকবে, আমাদের ব্যবসা–বাণিজ্যসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ বিদেশি অংশীদার বা সহযোগীরা ফিরে আসতে বা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন না এবং সে ক্ষেত্রে তাঁরা অন্য প্রতিযোগী দেশের প্রতি আকৃষ্ট হবেন। আমরা প্রতিযোগিতাসক্ষমতায় পিছিয়ে পড়তে পারি, এ আশঙ্কা যথেষ্ট যৌক্তিক। 

 ব্যক্তি করদাতার ন্যূনতম করহার ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ করহার ৩০ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ এবং ব্যক্তি করদাতার করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাবে সরকারি সিদ্ধান্তের প্রশংসা করতইে হব। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর কারণে করদাতাদের এই নিম্নভাগ সামান্য হলেও স্বস্তি পাবে। মোবাইলের কলচার্জ ও ইন্টারনেট ব্যবহারে কর বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি ডিজিটাল বাংলাদেশ দর্শনের বিপরীত। এই সংকটকালে যখন মুখোমুখি বা ব্যক্তিগত সাক্ষাৎ গুরুতরভাবে কমে গেছে, তখন এটি পরিবারের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটাবে। সেই সঙ্গে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসার খরচ আরও বাড়াবে, যা তাঁদের টিকে থাকার প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে। কমপক্ষে আগামী অর্থবছরের জন্য এই কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

 করপোরেট করহার কমানোর সিদ্ধান্তকে সঠিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছি। এই কঠিন সময়ে এমন পদক্ষেপ বহু কাঙ্ক্ষিত স্বস্তি আনবে। প্রস্তাবিত বাজেট অতালিকাভুক্ত কোম্পানির বর্তমান করপোরেট কর ৩৫ থেকে কমিয়ে ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ করেছে এবং পাবলিক কোম্পানির করহার ২৫ শতাংশ অপরিবর্তিত রেখেছে। দেশের বেশির ভাগ করপোরেট সত্তা অতালিকাভুক্ত কোম্পানি, তাদের ওপর উচ্চ করহার এবং লভ্যাংশের ওপর কর আরোপ এ অঞ্চল ও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশকে অনাকর্ষণীয় ব্যবসার গন্তব্য করে তুলেছে। আশা করি, পরবর্তী কয়েক বছরে করপোরেট করহার কমানোর এই ধারা অব্যাহত থাকবে। এই করপোরেট করহার কমানোর পূর্ণ সুবিধা পেতে হলে অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে (উৎসে কর্তিত কর) কমিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অগ্রিম আয়করের প্রভাব খুব বেশি এবং মাঝেমধ্যে যথাযথ করারোপের ভিত্তিতে পরিশোধিতব্য করের চেয়েও বেশি। অগ্রিম আয়করকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত করের দায় হিসেবে মনে করা হয়, যা উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যবসার ব্যয় বাড়িয়ে দেয় এবং ব্যবসার স্থায়িত্ব ও প্রতিযোগিতাসক্ষমতা কমিয়ে দেয়। শিল্পের ক্ষেত্রে ন্যূনতম শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ কর প্রযোজ্য, যেটি নতুন কোম্পানির ক্ষেত্রে আরও একটি বোঝা, এমনকি ব্যবসা শুরুর পরপরই কার্যকর হয় যা থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় না। এটি বাতিল হওয়া উচিত বা কমপক্ষে ব্যবসা শুরুর প্রথম ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত প্রযোজ্য হওয়া উচিত নয়।

>বড় দুশ্চিন্তার নাম এখন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান। নতুন বাজেট এই সমস্যার সমাধান কতটা করতে পারবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। আবার বিষয়টি নিয়ে বেসরকারি খাতের ভাবনা জানাটাও গুরুত্বপূর্ণ। এসব নিয়ে কথা বলেছেন বেসরকারি খাতের একজন নেতা।

 ব্যবসায় খাতে প্রধানমন্ত্রী যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন, সেগুলো যথোপযুক্ত শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হাতে দ্রুত পৌঁছে দেওয়া দরকার। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকসমূহ ও গ্রাহকদের মধ্যে সমন্বয় করে প্রক্রিয়াগুলো সহজ করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কোনো বিশেষ খাতের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ না দিয়ে ‘সমগ্র দেশ, সমগ্র অর্থনীতি’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সামষ্টিক চাহিদা বৃদ্ধির জন্য শুধু ব্যাংক ব্যবস্থার অর্থসংস্থানের ওপর নির্ভর করলে হবে না, সরকারি কোষাগার থেকে অর্থনীতিতে সরাসরি অর্থসংস্থান করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে এই অস্থিতিশীল সময়ে ঋণ দেওয়ায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম সংযোজন করতে হবে। এখানে প্রণোদনা চাইলে কর্মী ছাঁটাই করা যাবে না, এ ধরনের শর্ত আরোপ করা যেতে পারে। আবার কর আরোপ এবং আদায়ের ব্যাপারে সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। অগ্রিম আয়কর এবং মূসক ব্যবসার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং এই প্রথা থেকে রাজস্ব আহরণব্যবস্থাকে সরে আসতে হবে। রাজস্বনীতিকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো উদাহরণের (গ্লোবাল বেস্ট প্র্যাকটিস) আলোকে পুনর্বিন্যাস করার প্রয়োজন ও সুযোগ আগামী বছরে রয়েছে। 

 মাত্র ১০ শতাংশ কর পরিশোধের মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার জন্য নির্বিচার সুযোগ দেওয়া গভীর উদ্বেগের কারণ। আমরা অতীতে দেখেছি এ রকম ছাড়ে খুব বেশি ফল আসেনি; মাঝখান থেকে আমাদের আর্থিক এবং অ্যাকাউন্টিং চর্চার সততা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। লাভক্ষতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এতে প্রায় কোনো লাভই হয়নি; বরং সৎ এবং নিয়মিত করদাতাদের জন্য এটা একটা শাস্তিস্বরূপ। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো যে এই টাকা বিনা প্রশ্নে ব্যাংক হিসাবে জমা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলে তাতে আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং আইন ও নীতিসমূহ ভঙ্গ হতে পারে, যা বাংলাদেশি ব্যাংকের আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনে বাধার সৃষ্টি করবে, যেটা অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হতে পারে। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়া এ ধরনের অর্থ ব্যাংক হিসাবে জমা রাখার অনুমোদন দেওয়া অবশ্যই উচিত হবে না। 

 লেনদেন করার সময় চালানে বেশি মূল্য দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) বা কম মূল্য দেখানোর (আন্ডার ইনভয়েসিং) জন্য বাজেটে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা প্রশংসাযোগ্য। অথচ, কিছু অসাধু ব্যক্তি কর্তৃক দেশের বাইরে অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তরের প্রমাণিত ঘটনা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না; এমনকি টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন; এবং ভবিষ্যতে অর্থ পাচার রোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যাই হোক, নতুন এই বিধান প্রবর্তনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রকৃত লেনদেন এমনকি আমদানি-রপ্তানির ব্যয় মেটানোর ক্ষেত্রে যেন ইচ্ছাকৃত জটিলতা সৃষ্টি না করা হয়। 

 চলমান মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনীতি এখন অনিশ্চিত। তাই প্রতি তিন মাস অন্তর বাজেটের একটি অন্তর্বর্তীকালীন মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন, যাতে করে চলমান পরিবর্তনশীল প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দগুলো এবং প্রাধান্যগুলো নতুন করে সাজানো যায়। তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি ও নমনীয়তা বা ফ্লেক্সিবিলিটি থাকতে হবে। 

 বাজেট পেশ হয়ে গেছে। এটা কতটা আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা সবচেয়ে বেশি নির্ভর করবে সঠিক ও সময়মতো বাস্তবায়ন এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, বাহুল্য ব্যয় এবং অপচয় রোধের ওপর। আমার দৃষ্টিতে, কী পাইনি তার হিসাব না মিলিয়ে, যা পেয়েছি তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর আমাদের মনোনিবেশ করা প্রয়োজন।

নিহাদ কবির, সভাপতি, এমসিসিআই